দীর্ঘদিন ধরেই আমি ভেবেছি প্রকৃতি সুন্দর, পাহাড় বিরাট, নদী খরস্রোতা এবং সমুদ্র বিশাল, আর আমাদের ভালো লাগালাগি এই বাইরের সৌন্দর্য্যের সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু ক্রমশঃ মনে হচ্ছে, তা হয়তো নয়। সেন্স অফ বিউটি, ভালোবাসার মতনই, খুবই ব্যক্তিগত। দৃশ্য নয়, প্রায়শঃই তা প্রিয় মানুষদের সাথে জড়িয়ে থাকে। রবি ঠাকুরের কবিতায় আছে না, "গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম সুন্দর, সুন্দর হল সে", সেই কথাটার যথার্থতা ধীরে ধীরে বুঝছি হয়তো।
যে লেখাটা দাদু দিদাকে নিয়ে লিখবো ভেবে শুরু করেছিলাম, তার শুরুতেই সৌন্দর্য্যের তত্ত্ব তালাশ করাটা একটু অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু সম্পূর্ণ অর্থহীন নয়। জল আমার বেশি প্রিয়, সবুজ কিংবা পাহাড়ের চেয়ে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর ভাষায় বললে, আমার ঈশ্বর থাকেন জলে, স্থলে কিংবা অন্তরীক্ষে নয়। এখানে একটা ভারী সুন্দর লেক আছে, শীতকালে মা যখন এসেছিলো তখন পুরোটাই বরফ, এখন সেখানে অতলান্ত জল। এক একদিন সকালে উঠে আমার মনে হয় আমাকে সেখানে যেতেই হবে। সেরকমই একটা দিনে খুব সুন্দর রোদ্দুর উঠেছে, যাকে বলে পায়রা পিছলে যাবে এমন নির্মেঘ আকাশ, আমি একলা বসে আছি সেই গাঢ় সবজেটে নীল লেকের ধারে যার দুই পাড় জুড়ে দীর্ঘ পাইন গাছের সারি, উত্তরাশা বাতাস মৃদু চুমু খেয়ে যাচ্ছে কানের লতিতে, এবং আমি খুব মন দিয়ে ভাবার চেষ্টা করছি, এযাবৎ আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলো কি কি। অরোরা বোরিয়ালিস না গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, নর্মদা ফলস না কালিম্পঙ এর ঘুম জড়ানো কুয়াশা মাখা পাহাড়। খুব আশ্চর্য ভাবে আমার চোখে ভেসে উঠছে চতুর্থীর রাত: কেওড়াতলা মহাশ্মশানে তখন দিদার দাহ শেষ, মামা আর মার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে দাদু, দুটো হাত দুজনের কাঁধের উপরে, যেমন অতিদীর্ঘ বনস্পতির স্নেহ ঢেকে রাখে শাবকের পেলব কুসুম। মৃত্যুর মতো অমোঘ বেদনার মধ্যেও এমন অদ্ভুত সুন্দর এক একটা দৃশ্য তৈরি হতে পারে, ইরানিয়ান সিনেমায় নয়, আমাদের এই অতি সাধারণ দিন যাপনেও, না দেখলে বিশ্বাসই হতোনা। দাদু দিদাকে নিয়ে লিখতে গেলে, ভাবতে গেলে, এই দৃশ্যটাই আমার প্রথম মনে আসে।
দাদুকে নিয়ে লেখা আমার এই প্রথম নয়। নরেন্দ্রপুরে ক্লাস ফাইভের প্রথম মান্থলিতে ইংরেজি পরীক্ষায় রচনা এসেছিলো: দ্য ম্যান হু ইনফ্লুয়েন্সেস ইউ মোস্ট। সেটাতে আমি দাদুকে নিয়ে লিখি। খাতা বেরোলে জয়ন্তদা (আমাদের ইংরেজি শিক্ষক, স্কুলে সবাইকেই দাদা বলার রেওয়াজ ছিল) বলেছিলেন উনি নেতাজী স্বামীজী কিংবা মহাত্মা গান্ধী গোছের কিছু এক্সপেক্ট করছিলেন। দ্বিতীয় মান্থলীতে এসেছিল দ্য ম্যান ইউ এডমায়ার মোস্ট, সেখানেও দাদু। রচনা পড়ে জয়ন্তদা দাদুকে দেখতে চেয়েছিলেন। সে আশা পূর্ণ হতে বেশী দেরি হয়নি। নরেন্দ্রপুরে দুসপ্তাহ অন্তর গার্জিয়ানদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ ছিল তিন ঘন্টার জন্যে, যার পোশাকি নাম ছিল ভিজিটিং ডেট। আমার ছয় বছরের স্কুল জীবনে এমন কোন ভিজিটিং ডেট আসেনি যাতে দাদুকে দেখা যায়নি। স্কুল ছাড়ার পরেও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধুদের সঙ্গে কথাবার্তা হলে তারা জিজ্ঞেস করতো তোর দাদু কেমন আছেন। নাতি নাতনিরা তো দাদু দিদার কাছে আবদার করেই থাকে, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা শুধু সেটাই ছিলোনা তো, যতদূর মনে পড়ে ছোটবেলা থেকেই, আমার বড়ো হওয়ার বেশিরভাগ দায় দ্বায়িত্ত্ব দাদুর উপরে ছেড়ে দিয়ে বাবা মোটামুটি নিঃশ্চিন্ত ছিল। আমিও এক প্রকারে বেঁচেই গেছিলাম, বাবার ধৈর্য্য খুব একটা বেশী ছিলোনা এ ব্যাপারে। খুব ছোটবেলায় অমিতাভ জানার অঙ্ক বই পাওয়া যেত, বাবার সঙ্গে মুখে মুখে অঙ্ক প্র্যাক্টিস করতাম মনে পড়ে। কিন্ত মোটামুটি পুরুলিয়ার শেষ বছর (আমার তখন ক্লাস টু) থেকে দাদুই পড়াশুনোর ব্যাপারে আমার সব। দাস ফ্যামিলির পরম্পরায় মা ভালো পড়াতে পারতো, আমার ক্ষেত্রে খুব একটা সুযোগ পায়নি, যদিও চিন্তা করেছে খুব। মুখে মুখে অঙ্ক করার কথাই ধরোনা, যাকে সাধু ভাষায় মানসাঙ্ক বলে। মার খুব ভয় ছিল এইটা করলে স্টেপ জাম্প করার অভ্যেস হবে, পরীক্ষায় ভুল হবে। দাদু কিন্তু খুব এনকারেজ করতো, পরে মানিক মামা বলেছিলো এটা একটা খুব ভালো হ্যাবিট, আমার নিজেরও সেটাই ধারণা ( নোট টু আপকামিং পেরেন্টস 🙂 )। মানুষের কর্ম কিন্তু থেকেই যায়, আমার পিএইচডির শেষ প্রান্তে এসে বাবা মা সেটা বুঝেছে, কিন্তু সে গল্প অন্যত্র। অবশ্যই আমার নিজের একটু বায়াস আছে, কিন্তু পড়ানোর ক্ষেত্রে দাদুর মতো ধৈর্য্য আমি খুব খুব কম লোকের দেখেছি। ২৫ বছরের ছাত্র জীবনে একমাত্র যাদবপুর এর এক প্রফেসর। শুধু আমাকে নয়, মার কিছু স্টুডেন্টকে দাদু বছর দুয়েক পড়িয়েছিলো, তারাও পাশ করার পরে দীর্ঘদিন দাদুর খবর নিতো। গত বছরে ইউনিভার্সিটিতে একটা ক্লাস পড়ানোর সুযোগ হয়েছিল আমার, লক্ষ্য করলাম সব ব্যাপারে ঢিলেঢালা হলেও এই একটি ব্যাপারে আমি ভয়ানক সিরিয়াস, কোনো কারণে আমার স্টুডেন্টরাও মোটের উপরে আমাকে ভালোবাসে দেখি, এখনও দেখা হলে কুশল জিজ্ঞাসা করে। আমার ধারণা দাদুর থেকে এই একটি মাত্র গুণ আমি পেয়েছি। তা নাহলে আমার ক্রোমোজোম ভগবানের একটা বিচ্ছিরি ইয়ার্কি, দুই ফ্যামিলির যা যা খারাপ সবই ডমিনেন্ট জিন হিসেবে উঠে এসেছে।
ওয়েস্ট বেঙ্গল জয়েন্টে আমাদের প্রথম পরীক্ষা ছিল অঙ্ক। এতো খারাপ হয়েছিল যে হল থেকে বেরিযে বলেছিলাম আর কোনো পরীক্ষা দেবোনা, দাদু জোর না করলে হয়তো আর দিতামই না। ছোটবেলা থেকেই আমি বাবার মতোই একগুঁয়ে, মার প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও হায়ার সেকেন্ডারীতে নিজের ইচ্ছায় বায়োলজি ছেড়ে স্ট্যাটিস্টিক্স নিয়েছিলাম, এবং বাবা মাও মোটামুটি আমার উপর নিজেদের ইচ্ছে ফলানোৱ চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছিলো ক্লাস সেভেন এইট থেকেই। একমাত্র দাদুর কথাই কোনোদিন অগ্রাহ্য করিনি, এবং আমার সমস্ত আবদারেও দাদু সঙ্গ দিয়েছে, আমার আর দাদুর মধ্যে দারুণ আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল এ ব্যাপারে। ক্লাস নাইন এ পড়তে পড়তে আমি প্রথম কম্পিউটার কিনি, সকলেই জানতো তার ব্যবহার খুবই কম হবে, আমি তো বছরে দুমাস বাড়িতে থাকতাম। দাদুও জানতো, কিন্তু বাবা মার সাথে ভীষণ যুদ্ধ করে জোগাড় করে দিয়েছিলো সেটা। ক্লাস এইটে খুব রেজাল্ট খারাপ হচ্ছিলো মাঝখানে, দাদু তখন গুজরাটে, মামার কাছে, একটা ভারী সুন্দর চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলো, মুক্তোর মত হাতের লেখায়। সেই একটি মাত্র কনভারসেশন আমার দাদুর সাথে, যেখানে দাদু নিজের ছোটবেলার কথা লিখেছিলো। আমি চিরকালই খুব অগোছালো, পরীক্ষার আগে আমার দেখতে সুবিধা হবে বলে দু তিনটে বই এর অঙ্ক দাদু নিজে করে রাখতো, স্কুল জীবনে যে মোটামুটি ভালো রেজাল্ট হতো, আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি, দাদুর কতটা শ্রম আর ভালোবাসা ছিল তার পিছনে। খুব গভীর একটা হতাশা রয়ে গেছে জীবনে যে দাদুর থেকে জীবনের শিক্ষাটা নেওয়া হয়নি, কারণ সেটার জন্য যে পরিণত মানসিকতার দরকার হয়, সেটা আসার আগেই দাদু চলে গেলো। তখন তো ডিজিটাল যুগ ছিলোনা, সে সমস্ত চিঠিপত্র, হাতে লেখা কিছুই আর নেই যে ফিরে দেখবো। অসম্ভব চাপা মানুষ ছিল, খুব চেষ্টা করেও মনে করতে পারিনা কোনদিন কোন আবেগ প্রকাশ করতে দেখেছি বলে, গীতায় যাকে বলেছে দুঃখেষু অনুদ্বিগ্নমনা সুখেষু বিগতস্পৃহঃ। কেবল একটিবার রেগে যেতে দেখেছিলাম, সে গল্প পরে কখনো বলবো। মনে অসম্ভব জোর ছিল, সে অবশ্য তোমরা আমার থেকে ভালো জানবে। আর ছিল অসম্ভব অর্গানাইজেশন। হাউজিং সোসাইটির কি একটা ব্যাপার নিয়ে কারো সাথে গন্ডগোল হয়েছিল, দাদু প্রায় পনেরো বছরের পুরোনো একটা বই খুঁজে বার করে সারা রাত ধরে পড়াশুনো করেছিল, এইটা আমার নিজের চোখে দেখা। যে কোনো মানুষের উপরে অবিচল বিশ্বাস ছিল সারা জীবন, জীবনের শেষ পর্যন্ত লোকজন তার অপব্যবহার করেছে, কিন্তু দাদুর ধারণা তাতে পাল্টায়নি। কিন্তু মুশকিল হলো এই গুলো আমি দাদুর থেকে নিতে পারিনি। কখনো ভেঙে পড়লে মা বলে তুমি দাদুর নাতি না! কিন্তু খুব অসহায় ভাবে আমি বুঝতে পারি যে শেখা হয়নি, দাদুর থেকে কনসাসলি কিছু নিয়ে ওঠা হয়নি। এ একটা চরম দুর্ভাগ্য।
দিদা ছিল দাদুর ডায়মেট্রিক্যালি অপোজিট, দাদু যতটাই চাপা, যতটাই শান্ত, দিদা ততটাই ব্যক্ত। এখন মনে হয় সেই জন্যেই এতটা নিবিড় ছিল সেই দাম্পত্য। ভগবানে গভীর বিশ্বাসী ছিল দিদা, দাদুর বিশ্বাস মনে হয় মানুষের উপরেই বেশী ছিল। আমার জন্যে দিদা যা করেছে তা মা ভালো জানে, কখনো সুযোগ পেলে হয়তো লিখবে। সোসাইটির কোনো একটা পুজোয় মালপোয়া প্রসাদ ছিল, আমার খুব ভালো লেগেছিল বলে প্রায় জনা পঞ্চাশ লোকের সঙ্গে ঝগড়া করে দিদা আমার জন্যে নিয়ে এসেছিলো যতোটুকু বেশী ছিল। ছোট বাচ্ছাদের মতো সরল ছিল, খুব ভালো রান্না করতো তো, আর প্রশংসা করলে এতো খুশী হতো যে ভাবা যায়না। রোজগেরে গিন্নি বলে ইটিভিতে একটা সিরিয়াল হতো, সেইটা দেখা ছিল প্রায় অবশ্য কর্তব্য। আমিও দেখেছি কতদিন দিদার সাথে বসে। সেই সময়ে চ্যানেল চেঞ্জ করলে খুব রেগে যেত। পাঁচফোড়ন দিয়ে একটা আলুচচ্চড়ি হয়না, সেইটা মা দিদার থেকে ভালো বানাতো চিরকাল। সেটা বললেও খুব রেগে যেত, বাচ্ছাদের মতনই। বলতো তাহলে মায়ের রান্নাই খা, আমার হাতে আর খেতে হবেনা। যাদবপুরের ফার্স্ট ইয়ারে সল্টলেকেই তো থাকতাম, শুধু সপ্তাহে একদিন এর জন্যে বারাসাত যেতাম, সেইটা নিয়েও খুব আপত্তি ছিল। কেন যাবি, ওখানে কি কেউ আমার মতন দেখবে? বিবি এইট এর চারতলার ফ্ল্যাট থেকে নেমে যখন সামনের রাস্তা দিয়ে যেতাম, দিদা ততক্ষণ হাত নাড়তো যতক্ষণ না শেষটুকু দেখা যায়। ২০০৬ এর পুজোতে তৃতীয়ার দিন সকাল বেলায় বেরোলাম, যাদবপুর যাবো, সেখান থেকে বারাসাত, ষষ্ঠীর দিন রাতে ফিরবো সল্টলেকে। দিদা ওপর থেকে টা টা করলো, সেই আমার শেষ দেখা। মৃত্যু যে এতো এতো চকিত হতে পারে, এখনো বিশ্বাস হয়না।
দাদু দিদাকে নিয়ে লেখার সমস্যা হচ্ছে যে কলেবরে এটা ক্রমশঃ বাড়তেই থাকবে, কারণ এক একটি লাইন লেখার পরেই অজস্র স্মৃতিরা ছবির মতন ভিড় করে আসে। সেই বন্যা ঠেকানো কঠিন, খুবই কঠিন, এবং স্মৃতিচারণ কিভাবে শেষ হয় সেই ব্যাকরণ আমার জানা নেই, তাই আচমকাই দাঁড়ি টেনে দিচ্ছি। শুধু এটুকুই লিখি, এখনো চোখ বন্ধ করলে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই বিবি এইট বাই সেভেন এ দাদু দিদার ঘর; ডবল বেড খাটে বসে গল্প করছে মা, দিদা আর মিমি (মুক্তা), দাদু আর মামা হেলান দিয়ে শুয়ে, খাটের উপরে খেলা করছে ঋজু; দু নম্বর ট্যাঙ্কে নেমে ফোন করেছে বাবা; দিদা উঠলো চায়ের জল চাপাতে যাবে বলে। জানালার ধারে একটা কম্পিউটার এর টেবিল, তাতে বসে আমি গেম খেলছি, আর মাঝে মাঝে শুনছি। দক্ষিণ খোলা জানালা, হাওয়া দিচ্ছে খুব, হুহু করে, যেরকম হাওয়ায় খুব ভালো লাগে আবার চোখ জ্বালা জ্বালা করে, মন খারাপ হয়। সেরকম হাওয়া আর কোথাও দেয়না আজ।
পুনশ্চ: গোর্কি অনেকদিন ধরেই বলেছে দাদু দিদাকে নিয়ে কিছু লিখতে। আমি বলেছি সময় হয়ে উঠছেনা। সময় হচ্ছেনা বলাটা আপাতঃ দৃষ্টিতে খুব ভুল, পিএইচডি শেষ, নতুন কাজ শুরু হতে একটু দেরী আছে, সময়ের আবার অভাব কি। আবার গভীর ভাবে ভেবে দেখলে, কথাটা খুব ঠিকও। যেকোনো লেখার পিছনে অপেক্ষার একটা দীর্ঘ সময় থাকে। যেমন একাকী সৈনিক। সে তার তরবারিতে ধার দিয়ে যাচ্ছে দিয়ে যাচ্ছে। একদিন হঠাৎ তাতে বিদ্যুৎ খেলে যায়, শানিত ইস্পাত ঝিকিয়ে ওঠে। তারপর শাদা পাতার সঙ্গে যুদ্ধ হয়। সেই সময়টা না কাটলে যুদ্ধক্ষেত্রে ম্যাসাকার হবে তো!
যে লেখাটা দাদু দিদাকে নিয়ে লিখবো ভেবে শুরু করেছিলাম, তার শুরুতেই সৌন্দর্য্যের তত্ত্ব তালাশ করাটা একটু অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু সম্পূর্ণ অর্থহীন নয়। জল আমার বেশি প্রিয়, সবুজ কিংবা পাহাড়ের চেয়ে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর ভাষায় বললে, আমার ঈশ্বর থাকেন জলে, স্থলে কিংবা অন্তরীক্ষে নয়। এখানে একটা ভারী সুন্দর লেক আছে, শীতকালে মা যখন এসেছিলো তখন পুরোটাই বরফ, এখন সেখানে অতলান্ত জল। এক একদিন সকালে উঠে আমার মনে হয় আমাকে সেখানে যেতেই হবে। সেরকমই একটা দিনে খুব সুন্দর রোদ্দুর উঠেছে, যাকে বলে পায়রা পিছলে যাবে এমন নির্মেঘ আকাশ, আমি একলা বসে আছি সেই গাঢ় সবজেটে নীল লেকের ধারে যার দুই পাড় জুড়ে দীর্ঘ পাইন গাছের সারি, উত্তরাশা বাতাস মৃদু চুমু খেয়ে যাচ্ছে কানের লতিতে, এবং আমি খুব মন দিয়ে ভাবার চেষ্টা করছি, এযাবৎ আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলো কি কি। অরোরা বোরিয়ালিস না গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, নর্মদা ফলস না কালিম্পঙ এর ঘুম জড়ানো কুয়াশা মাখা পাহাড়। খুব আশ্চর্য ভাবে আমার চোখে ভেসে উঠছে চতুর্থীর রাত: কেওড়াতলা মহাশ্মশানে তখন দিদার দাহ শেষ, মামা আর মার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে দাদু, দুটো হাত দুজনের কাঁধের উপরে, যেমন অতিদীর্ঘ বনস্পতির স্নেহ ঢেকে রাখে শাবকের পেলব কুসুম। মৃত্যুর মতো অমোঘ বেদনার মধ্যেও এমন অদ্ভুত সুন্দর এক একটা দৃশ্য তৈরি হতে পারে, ইরানিয়ান সিনেমায় নয়, আমাদের এই অতি সাধারণ দিন যাপনেও, না দেখলে বিশ্বাসই হতোনা। দাদু দিদাকে নিয়ে লিখতে গেলে, ভাবতে গেলে, এই দৃশ্যটাই আমার প্রথম মনে আসে।
দাদুকে নিয়ে লেখা আমার এই প্রথম নয়। নরেন্দ্রপুরে ক্লাস ফাইভের প্রথম মান্থলিতে ইংরেজি পরীক্ষায় রচনা এসেছিলো: দ্য ম্যান হু ইনফ্লুয়েন্সেস ইউ মোস্ট। সেটাতে আমি দাদুকে নিয়ে লিখি। খাতা বেরোলে জয়ন্তদা (আমাদের ইংরেজি শিক্ষক, স্কুলে সবাইকেই দাদা বলার রেওয়াজ ছিল) বলেছিলেন উনি নেতাজী স্বামীজী কিংবা মহাত্মা গান্ধী গোছের কিছু এক্সপেক্ট করছিলেন। দ্বিতীয় মান্থলীতে এসেছিল দ্য ম্যান ইউ এডমায়ার মোস্ট, সেখানেও দাদু। রচনা পড়ে জয়ন্তদা দাদুকে দেখতে চেয়েছিলেন। সে আশা পূর্ণ হতে বেশী দেরি হয়নি। নরেন্দ্রপুরে দুসপ্তাহ অন্তর গার্জিয়ানদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ ছিল তিন ঘন্টার জন্যে, যার পোশাকি নাম ছিল ভিজিটিং ডেট। আমার ছয় বছরের স্কুল জীবনে এমন কোন ভিজিটিং ডেট আসেনি যাতে দাদুকে দেখা যায়নি। স্কুল ছাড়ার পরেও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধুদের সঙ্গে কথাবার্তা হলে তারা জিজ্ঞেস করতো তোর দাদু কেমন আছেন। নাতি নাতনিরা তো দাদু দিদার কাছে আবদার করেই থাকে, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা শুধু সেটাই ছিলোনা তো, যতদূর মনে পড়ে ছোটবেলা থেকেই, আমার বড়ো হওয়ার বেশিরভাগ দায় দ্বায়িত্ত্ব দাদুর উপরে ছেড়ে দিয়ে বাবা মোটামুটি নিঃশ্চিন্ত ছিল। আমিও এক প্রকারে বেঁচেই গেছিলাম, বাবার ধৈর্য্য খুব একটা বেশী ছিলোনা এ ব্যাপারে। খুব ছোটবেলায় অমিতাভ জানার অঙ্ক বই পাওয়া যেত, বাবার সঙ্গে মুখে মুখে অঙ্ক প্র্যাক্টিস করতাম মনে পড়ে। কিন্ত মোটামুটি পুরুলিয়ার শেষ বছর (আমার তখন ক্লাস টু) থেকে দাদুই পড়াশুনোর ব্যাপারে আমার সব। দাস ফ্যামিলির পরম্পরায় মা ভালো পড়াতে পারতো, আমার ক্ষেত্রে খুব একটা সুযোগ পায়নি, যদিও চিন্তা করেছে খুব। মুখে মুখে অঙ্ক করার কথাই ধরোনা, যাকে সাধু ভাষায় মানসাঙ্ক বলে। মার খুব ভয় ছিল এইটা করলে স্টেপ জাম্প করার অভ্যেস হবে, পরীক্ষায় ভুল হবে। দাদু কিন্তু খুব এনকারেজ করতো, পরে মানিক মামা বলেছিলো এটা একটা খুব ভালো হ্যাবিট, আমার নিজেরও সেটাই ধারণা ( নোট টু আপকামিং পেরেন্টস 🙂 )। মানুষের কর্ম কিন্তু থেকেই যায়, আমার পিএইচডির শেষ প্রান্তে এসে বাবা মা সেটা বুঝেছে, কিন্তু সে গল্প অন্যত্র। অবশ্যই আমার নিজের একটু বায়াস আছে, কিন্তু পড়ানোর ক্ষেত্রে দাদুর মতো ধৈর্য্য আমি খুব খুব কম লোকের দেখেছি। ২৫ বছরের ছাত্র জীবনে একমাত্র যাদবপুর এর এক প্রফেসর। শুধু আমাকে নয়, মার কিছু স্টুডেন্টকে দাদু বছর দুয়েক পড়িয়েছিলো, তারাও পাশ করার পরে দীর্ঘদিন দাদুর খবর নিতো। গত বছরে ইউনিভার্সিটিতে একটা ক্লাস পড়ানোর সুযোগ হয়েছিল আমার, লক্ষ্য করলাম সব ব্যাপারে ঢিলেঢালা হলেও এই একটি ব্যাপারে আমি ভয়ানক সিরিয়াস, কোনো কারণে আমার স্টুডেন্টরাও মোটের উপরে আমাকে ভালোবাসে দেখি, এখনও দেখা হলে কুশল জিজ্ঞাসা করে। আমার ধারণা দাদুর থেকে এই একটি মাত্র গুণ আমি পেয়েছি। তা নাহলে আমার ক্রোমোজোম ভগবানের একটা বিচ্ছিরি ইয়ার্কি, দুই ফ্যামিলির যা যা খারাপ সবই ডমিনেন্ট জিন হিসেবে উঠে এসেছে।
ওয়েস্ট বেঙ্গল জয়েন্টে আমাদের প্রথম পরীক্ষা ছিল অঙ্ক। এতো খারাপ হয়েছিল যে হল থেকে বেরিযে বলেছিলাম আর কোনো পরীক্ষা দেবোনা, দাদু জোর না করলে হয়তো আর দিতামই না। ছোটবেলা থেকেই আমি বাবার মতোই একগুঁয়ে, মার প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও হায়ার সেকেন্ডারীতে নিজের ইচ্ছায় বায়োলজি ছেড়ে স্ট্যাটিস্টিক্স নিয়েছিলাম, এবং বাবা মাও মোটামুটি আমার উপর নিজেদের ইচ্ছে ফলানোৱ চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছিলো ক্লাস সেভেন এইট থেকেই। একমাত্র দাদুর কথাই কোনোদিন অগ্রাহ্য করিনি, এবং আমার সমস্ত আবদারেও দাদু সঙ্গ দিয়েছে, আমার আর দাদুর মধ্যে দারুণ আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল এ ব্যাপারে। ক্লাস নাইন এ পড়তে পড়তে আমি প্রথম কম্পিউটার কিনি, সকলেই জানতো তার ব্যবহার খুবই কম হবে, আমি তো বছরে দুমাস বাড়িতে থাকতাম। দাদুও জানতো, কিন্তু বাবা মার সাথে ভীষণ যুদ্ধ করে জোগাড় করে দিয়েছিলো সেটা। ক্লাস এইটে খুব রেজাল্ট খারাপ হচ্ছিলো মাঝখানে, দাদু তখন গুজরাটে, মামার কাছে, একটা ভারী সুন্দর চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলো, মুক্তোর মত হাতের লেখায়। সেই একটি মাত্র কনভারসেশন আমার দাদুর সাথে, যেখানে দাদু নিজের ছোটবেলার কথা লিখেছিলো। আমি চিরকালই খুব অগোছালো, পরীক্ষার আগে আমার দেখতে সুবিধা হবে বলে দু তিনটে বই এর অঙ্ক দাদু নিজে করে রাখতো, স্কুল জীবনে যে মোটামুটি ভালো রেজাল্ট হতো, আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি, দাদুর কতটা শ্রম আর ভালোবাসা ছিল তার পিছনে। খুব গভীর একটা হতাশা রয়ে গেছে জীবনে যে দাদুর থেকে জীবনের শিক্ষাটা নেওয়া হয়নি, কারণ সেটার জন্য যে পরিণত মানসিকতার দরকার হয়, সেটা আসার আগেই দাদু চলে গেলো। তখন তো ডিজিটাল যুগ ছিলোনা, সে সমস্ত চিঠিপত্র, হাতে লেখা কিছুই আর নেই যে ফিরে দেখবো। অসম্ভব চাপা মানুষ ছিল, খুব চেষ্টা করেও মনে করতে পারিনা কোনদিন কোন আবেগ প্রকাশ করতে দেখেছি বলে, গীতায় যাকে বলেছে দুঃখেষু অনুদ্বিগ্নমনা সুখেষু বিগতস্পৃহঃ। কেবল একটিবার রেগে যেতে দেখেছিলাম, সে গল্প পরে কখনো বলবো। মনে অসম্ভব জোর ছিল, সে অবশ্য তোমরা আমার থেকে ভালো জানবে। আর ছিল অসম্ভব অর্গানাইজেশন। হাউজিং সোসাইটির কি একটা ব্যাপার নিয়ে কারো সাথে গন্ডগোল হয়েছিল, দাদু প্রায় পনেরো বছরের পুরোনো একটা বই খুঁজে বার করে সারা রাত ধরে পড়াশুনো করেছিল, এইটা আমার নিজের চোখে দেখা। যে কোনো মানুষের উপরে অবিচল বিশ্বাস ছিল সারা জীবন, জীবনের শেষ পর্যন্ত লোকজন তার অপব্যবহার করেছে, কিন্তু দাদুর ধারণা তাতে পাল্টায়নি। কিন্তু মুশকিল হলো এই গুলো আমি দাদুর থেকে নিতে পারিনি। কখনো ভেঙে পড়লে মা বলে তুমি দাদুর নাতি না! কিন্তু খুব অসহায় ভাবে আমি বুঝতে পারি যে শেখা হয়নি, দাদুর থেকে কনসাসলি কিছু নিয়ে ওঠা হয়নি। এ একটা চরম দুর্ভাগ্য।
দিদা ছিল দাদুর ডায়মেট্রিক্যালি অপোজিট, দাদু যতটাই চাপা, যতটাই শান্ত, দিদা ততটাই ব্যক্ত। এখন মনে হয় সেই জন্যেই এতটা নিবিড় ছিল সেই দাম্পত্য। ভগবানে গভীর বিশ্বাসী ছিল দিদা, দাদুর বিশ্বাস মনে হয় মানুষের উপরেই বেশী ছিল। আমার জন্যে দিদা যা করেছে তা মা ভালো জানে, কখনো সুযোগ পেলে হয়তো লিখবে। সোসাইটির কোনো একটা পুজোয় মালপোয়া প্রসাদ ছিল, আমার খুব ভালো লেগেছিল বলে প্রায় জনা পঞ্চাশ লোকের সঙ্গে ঝগড়া করে দিদা আমার জন্যে নিয়ে এসেছিলো যতোটুকু বেশী ছিল। ছোট বাচ্ছাদের মতো সরল ছিল, খুব ভালো রান্না করতো তো, আর প্রশংসা করলে এতো খুশী হতো যে ভাবা যায়না। রোজগেরে গিন্নি বলে ইটিভিতে একটা সিরিয়াল হতো, সেইটা দেখা ছিল প্রায় অবশ্য কর্তব্য। আমিও দেখেছি কতদিন দিদার সাথে বসে। সেই সময়ে চ্যানেল চেঞ্জ করলে খুব রেগে যেত। পাঁচফোড়ন দিয়ে একটা আলুচচ্চড়ি হয়না, সেইটা মা দিদার থেকে ভালো বানাতো চিরকাল। সেটা বললেও খুব রেগে যেত, বাচ্ছাদের মতনই। বলতো তাহলে মায়ের রান্নাই খা, আমার হাতে আর খেতে হবেনা। যাদবপুরের ফার্স্ট ইয়ারে সল্টলেকেই তো থাকতাম, শুধু সপ্তাহে একদিন এর জন্যে বারাসাত যেতাম, সেইটা নিয়েও খুব আপত্তি ছিল। কেন যাবি, ওখানে কি কেউ আমার মতন দেখবে? বিবি এইট এর চারতলার ফ্ল্যাট থেকে নেমে যখন সামনের রাস্তা দিয়ে যেতাম, দিদা ততক্ষণ হাত নাড়তো যতক্ষণ না শেষটুকু দেখা যায়। ২০০৬ এর পুজোতে তৃতীয়ার দিন সকাল বেলায় বেরোলাম, যাদবপুর যাবো, সেখান থেকে বারাসাত, ষষ্ঠীর দিন রাতে ফিরবো সল্টলেকে। দিদা ওপর থেকে টা টা করলো, সেই আমার শেষ দেখা। মৃত্যু যে এতো এতো চকিত হতে পারে, এখনো বিশ্বাস হয়না।
দাদু দিদাকে নিয়ে লেখার সমস্যা হচ্ছে যে কলেবরে এটা ক্রমশঃ বাড়তেই থাকবে, কারণ এক একটি লাইন লেখার পরেই অজস্র স্মৃতিরা ছবির মতন ভিড় করে আসে। সেই বন্যা ঠেকানো কঠিন, খুবই কঠিন, এবং স্মৃতিচারণ কিভাবে শেষ হয় সেই ব্যাকরণ আমার জানা নেই, তাই আচমকাই দাঁড়ি টেনে দিচ্ছি। শুধু এটুকুই লিখি, এখনো চোখ বন্ধ করলে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই বিবি এইট বাই সেভেন এ দাদু দিদার ঘর; ডবল বেড খাটে বসে গল্প করছে মা, দিদা আর মিমি (মুক্তা), দাদু আর মামা হেলান দিয়ে শুয়ে, খাটের উপরে খেলা করছে ঋজু; দু নম্বর ট্যাঙ্কে নেমে ফোন করেছে বাবা; দিদা উঠলো চায়ের জল চাপাতে যাবে বলে। জানালার ধারে একটা কম্পিউটার এর টেবিল, তাতে বসে আমি গেম খেলছি, আর মাঝে মাঝে শুনছি। দক্ষিণ খোলা জানালা, হাওয়া দিচ্ছে খুব, হুহু করে, যেরকম হাওয়ায় খুব ভালো লাগে আবার চোখ জ্বালা জ্বালা করে, মন খারাপ হয়। সেরকম হাওয়া আর কোথাও দেয়না আজ।
পুনশ্চ: গোর্কি অনেকদিন ধরেই বলেছে দাদু দিদাকে নিয়ে কিছু লিখতে। আমি বলেছি সময় হয়ে উঠছেনা। সময় হচ্ছেনা বলাটা আপাতঃ দৃষ্টিতে খুব ভুল, পিএইচডি শেষ, নতুন কাজ শুরু হতে একটু দেরী আছে, সময়ের আবার অভাব কি। আবার গভীর ভাবে ভেবে দেখলে, কথাটা খুব ঠিকও। যেকোনো লেখার পিছনে অপেক্ষার একটা দীর্ঘ সময় থাকে। যেমন একাকী সৈনিক। সে তার তরবারিতে ধার দিয়ে যাচ্ছে দিয়ে যাচ্ছে। একদিন হঠাৎ তাতে বিদ্যুৎ খেলে যায়, শানিত ইস্পাত ঝিকিয়ে ওঠে। তারপর শাদা পাতার সঙ্গে যুদ্ধ হয়। সেই সময়টা না কাটলে যুদ্ধক্ষেত্রে ম্যাসাকার হবে তো!