Thursday, August 9, 2018

বাইশে শ্রাবণ

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমার পড়া সেরা বক্তব্য নবারুণ ভটচাজের থেকে পাওয়া। "জাহাজ ক্যাপ্টেন তুমি, বাকি সব মাঝি আর মাল্লা/ সকলে জাঙ্গিয়া পরে, তুমি একা পরে আলখাল্লা"। ব্যাপক হারে রবিনন্দন দেখলে এই লাইনদুটোই প্রথম মনে পড়ে। হঠাৎ ইন্টারনেটে আনন্দবাজার খুলে খেয়াল করলাম, চব্বিশে শ্রাবণ, মানে বাইশে শ্রাবণ পেরিয়ে গেছে দুদিন হলো। তেমন হাহাকার দেখিনি এবারে ফেসবুকে, প্রায় অমোঘ "কবি কে আমরা কি ভুলে গেলাম" ধারায় আনন্দবাজারীয় রোদনও চোখে পড়েনি। শতবর্ষ পার কি হবে গুরুদেব? কিভাবে একটা গান প্রিয় হয়? আমার ধারণা একটা গান শোনার সাথে মানুষ কখনো একটা স্মৃতির এসোসিয়েশন করে নেয়, আর সারা জীবন সেই কুসুমে ওম দিয়ে যায়। যে গানের সাথে স্মৃতির যোগ নেই, সেই গান প্রিয় নয়। হতে পারেনা। যতই খিল্লি করিনা কেন, আমার জীবনে অন্ততঃ এইখানেই গুরুদেব বাকি সব্বাইকে দশ গোল দিয়ে গেছেন। অজস্র ভালোলাগা, ভালোবাসা, কান্না ও অভিমানের স্মৃতি জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত ঘিরে। প্রকৃত প্রস্তাবে এই স্মৃতিগুলিই সব থেকে গোপন, সব চেয়ে ব্যক্তিগত। স্মৃতি ঋতুমতী নদীর মতো বহতা, সুতরাং খুব সামলিয়ে এক দিনের কথাই বলি। যেদিন বিক্রমের সঙ্গে পরিচয় হলো। বাড়িতে অজস্র ক্যাসেট ছিল সাগর সেন, সুবিনয় রায় এবং দেবব্রত বিশ্বাসের। স্বল্প কণিকা এবং কিছু সুচিত্রা মিত্র, মধ্যবিত্ত বাড়িতে যেরকম হয়। তখন আমেরিকায় এসেছি সবে সবে, বন্ধু বান্ধব জোটেনি তেমন। কোনো একটা কারণে অসম্ভব মন খারাপ। একটা লম্বা করিডোর এ খুব শাদা আলোর মধ্যে বসে বসে অন্ধকার খুঁজছি। ডিপ্রেসড হলে সোশ্যাল হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায় দেখেছি, সুতরাং পাগলের মতো ফেসবুক রিফ্রেশ করছি, এমন কিছু পাচ্ছিনা যাতে এক লহমার শান্তি পাই। কেউ একটা হঠাৎ শেয়ার করেছে দেখলাম একটা ইউটিউব ভিডিও, অচেনা কারো গলায় গাওয়া "আরো আঘাত সইবে আমার, সইবে আমারও"। গানটা আগে শুনিনি, হঠাৎ কি মনে করে ক্লিক করলাম। বহুদিন হয়ে গেলো তো, খুব স্পষ্ট ভাবে আমার কিছু মনে নেই, এবং থাকলেই হয়তো অসঙ্গত হতো। শুধু মনে আছে খোলা গলায় বিক্রমের গান আর মাঝে মাঝে তানপুরার মৃদু ঝংকার। লাগে না গো কেবল যেন কোমল করুণা, মৃদু সুরের খেলায় এ প্রাণ ব্যর্থ কোরো না। আগে পড়েছি তো কতবার, গান হয় হৃদয় নিংড়ানো। পরিচয় সেই প্রথম। সেই প্রথম জানা যে আকুতি হতে পারে এতো বলিষ্ঠ। জ্বলে উঠুক সকল হুতাশ,গর্জি উঠুক সকল বাতাস। বেদনা উন্মোচন করে জেগে ওঠেন পুরুষোত্তম। পুরো গানটা খেয়াল করলে দেখা যায়, এটা একটা জার্নি। বেদনা থেকে মুক্তির জার্নি। অন্ধকার থেকে আলোতে যাওয়ার জার্নি। আঘাত থেকে পূর্ণতায় যাওয়ার জার্নি। তমসো মা জ্যোতির্গময়। মৃত্যোর্মামৃতং গময়। ঝর ঝর করে কাঁদছি একা বসে, পাশ দিয়ে লোকজন চলে যাচ্ছে অবাক দৃষ্টি দিয়ে। এটুকুই মনে আছে শুধু। আর মনে আছে প্রথম আলাপ। বিক্রম সিংহের গলায় রবি ঠাকুর। মানব জীবন সতত সংক্ষুব্ধ। তবু ঊষালগ্নে কিছু কিছু মুহূর্তের জন্ম হয়। এই মুহূর্তেরা সূর্যের মতো শাশ্বত, পতিতপাবনী গঙ্গার মত পুণ্যতোয়া ও নিকোনো কুয়োর মত গহীন। এই মুহূর্ত গুলোর জন্যেই মানুষের মতো সচেষ্ট বেঁচে থাকা, অমরত্ব তাচ্ছিল্য করা। কিছু কিছু উচ্চারণ আমাদের সেই সব মুহূর্তের কাছে নিয়ে যায়। সেই উচ্চারণই ঈশ্বর, সৃষ্টির আদি নাদ। প্রণাম গুরুদেব, এরকম অজস্র উচ্চারণের সাথে আমাদের এই তুচ্ছ জীবনকে জুড়ে দেওয়ার জন্যে। বিক্রম সিংহের নিজস্ব জার্নি বহুদিন আগেই শেষ হয়ে গেছে। অসম্ভব প্রতিভাবান এই যুবক ত্রিশ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মোটর বাইক একসিডেন্ট এ মারা যান। বাংলা গানের কি ক্ষতি ইত্যাদি বক্তব্য দেওয়ার কোয়ালিফিকেশন আমার নেই। ব্যক্তিগত ক্ষতি অপূরণীয়। আমায় অনেক দিয়েছ নাথ, আমার বাসনা তবু পুরিল না-- গভীর প্রাণের তৃষা মিটিল না, মিটিল না ॥ পুনশ্চ : অনেক দিয়েছ নাথ: https://www.youtube.com/watch?v=C_p1HvNRSYg আরো আঘাত সইবে আমার, সইবে আমারও : https://www.youtube.com/watch?v=DJ63veAevII