নরেন্দ্রপুর অনেক কিছুই একটা ছেলের থেকে নিয়ে নেয়। আজকে হঠাৎ সুমনের গান শুনতে শুনতে মনে হলো, যে বয়েসে শোনার কথা ছিল "এ জীবন ভালোবেসে তোমাকে চাই", তখন আমরা ধুতি পরে গলায় উত্তরীয় দিয়ে দুলে দুলে গেয়েছি "গুরুদেব দয়া করো দীনজনে"। ধ্যাষ্টামো আর কাকে বলে।
যে কোনো দানের বদলে কিছু তো পায় মানুষ। আমরা আমাদের উদ্দাম কৈশোর, না হওয়া মিষ্টি প্রেমগুলি, ঝালমুড়ি ফুচকা এবং সুমনের গান ছেড়ে এলাম যে জামরুল ও করবী বৃক্ষে, সেই আম্রকুঞ্জ ও চিরহরিৎ প্রাঙ্গণ দিয়েছে অনেক কিছুই। এতো মায়া রয়ে গেলো আলপথে।
২৩-২৬ জানুয়ারী নরেন্দ্রপুরের দুর্গাপুজো, যাকে আমরা বলি একজিবিশন। বাৎসরিক ব্যাপার, যার প্রস্তুতি শুরু হয় অন্ততঃ নভেম্বরের শেষ থেকে। ইস্কুল বিল্ডিং এর প্রতিটা ঘর সেজে উঠবে ছোটদের হাতের লেখা আঁকা আলপনায়। খুব ছোট্ট যারা, সবে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছে কিংবা সিক্সে, তাদের বেশীর ভাগ লোকজনকে তোমরা দেখতে পাবে একটা ঘরে যার নাম লিটিল সায়েন্টিস্ট। ইস্কুল এর দিকে মুখ করে দাঁড়ালে বাম দিকের যে উইং পড়ে, সেই খানে দোতলায়। এখানে অন্য সময়ে ক্লাস এইট এর ডি সেকশনের ক্লাস হয়। ঘরটা বেশ বড়ো, এই ঘর জুড়ে হিমানীশ দৌড় করিয়ছিল নারায়ণ মহারাজ কে, সে বেশ দুতিন মিনিট ধরে চলেছিল ব্যাপারটা। জানালা দিয়ে তাকালে দেখতে পাওয়া যায় অডিটোরিয়াম যেখানে বচ্ছরে দু এক বার সিনেমা দেখার সুযোগ মেলে। সব দিন গুলোতে যে ঘরটা প্রায় জেলখানার মতন মনে হয়, তেইশ তারিখে সেখানে সার দিয়ে সাজানো ছোট্ট ছোট্ট টেবিল আর খুদে ডেমন্সট্রেটররা। বেশীর ভাগ দেখবে বানিয়েছে কেমিক্যাল ভলকানো আর মডেল ঘরবাড়ি যেখানে বৃষ্টি পড়লে আলো জ্বলে যায় কিংবা বাজনা বাজে। কোনো কোনো টেবিলে হয়তো দেখবে মন কষাকষি চলছে তুই তিনটের সময় এখানে ছিলিস না কেনো? আমার বাবা মা এসেছে যে? বাঃ আমাদের বাবা মা র সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা করেনা বুঝি? মাসে তো দুটো দিন মোটে। তাই বলে টেবিল ছেড়ে চলে যাবি? ছোট ছোট মান অভিমান, ছোট ছোট ছোট বন্ধুত্ব। কেউ কেউ তোমাদের প্রায় জোর করে বোঝানোর চেষ্টা করবে ফটোসিনথেসিস এর কারুকলা। তখন তাদের প্রথম অঙ্কুরোদ্গম, তখন তাদের ক্লাস ফাইভ। ওদের অতি উৎসাহ দেখে হেসোনা কিন্তু, বিশ বছর পরে ওরাই চালাবে ইসরো কিংবা বার্ক, ওদের ছুরি কাঁচিতে তোমার আত্মজ দেখবে এ পৃথিবীর আলো।
ওখান থেকে একটু এগিয়ে এলে দেখতে পাবে বাংলা ডিপার্টমেন্ট এর ঘর, সেখানে দেওয়াল জুড়ে এক দিকে রবীন্দ্রনাথ অন্য দিকে তারাশঙ্কর মানিক। হ্যাঁ হয়তো খুব প্রাজ্ঞ সমালোচনা নয়, কিন্তু একটু খেয়াল করে পড়লে বুঝবে পাঁচটা দশটার কঠিন নিগড় কাটিয়ে একটি লাজুক কিশোর হঠাৎ পড়ে ফেলেছে কবি কিংবা পুতুল নাচের উপকথা আর ভাবছে আহা সে কোন বনে ফোটে অমলতাস, কেমন সে হলুদ মায়াবী আলো। একটা কোণে একটু ঈষৎ বড়ো টেবিল ভিড়ে ভীড়াক্কার, সেখানে একটা অদ্ভুত জিনিস হচ্ছে, ডায়েরিতে কেউ লিখে দিয়ে যাচ্ছে ইচ্ছামতন শব্দ, একটি ছেলে সেই শব্দ ফুটিয়ে তুলছে রেখায় তুলিতে আর একটি ছেলে কবিতায়। এর নাম "ছবিতা"। ওই ঘর থেকে বেরিয়ে করিডোরের উল্টো দিকে তাকাও দেখবে দুটো ঘর জুড়ে অঙ্ক ডিপার্টমেন্টের মহাযজ্ঞ। কেউ ফিবোনাচ্চি সিরিজের মডেল বানিয়েছে কিংবা কেউ জলের মতো সহজে বোঝাচ্ছে গোল্ডেন রেশিও। মাঝখানে একটা নীল বোর্ডে খুব সুন্দর ক্যালিগ্রাফিতে কেউ লিখে রেখেছে "অঙ্ক ও কবিতায় নেই কোনো দ্বন্দ্ব, মিল থাক, নাই থাক, থাকে শুধু ছন্দ"। এই ছেলেটি বড়ো হয়ে বাংলার প্রফেসর হবে, কবিতায় এমন অদ্ভুত সুন্দর ভাবে ব্যবহার করবে ধৈবত শব্দটি যে আমি পড়ে চমকে উঠবো। যে যেখানে লিখে যায় আমাদেরই লেখা।
আর একটু এগিয়ে এসো সিঁড়ির সামনেটা পেরিয়ে যেখান থেকে দেখা যায় আমবাগানটা, দেখবে সার সার আলো জ্বলে উঠছে আস্তে আস্তে আর প্রতিদিনের মরা ইস্কুল বাড়ি কেমন ম্যাজিকের মতো পাল্টে যাচ্ছে উৎসবে। শরৎদা কে দেখতে পেতে পারো। ফটো তুলছেন মন দিয়ে, সেই সব ছবি গুলো কদিনের মধ্যে ডেভেলপ হয়ে উঠবে সামনের নোটিশ বোর্ডে। স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের এর একটা রুম, খুব গম্ভীর মুখে দুতিন টি ছেলে বসে আছে, এ বছরে কিছুই করা হলোনা, পরের বছরে একটা বড়ো প্রজেক্ট করতে হবে বুঝলি। ইতিহাসে করবো, ওরা অনেক গুলো ঘর পায়। তার ঠিক পাশেই লোকশিক্ষা পরিষদের ঘরে তখন বেদম ভীড়, ধূপকাঠি বিক্রি হচ্ছে প্রচুর আর চাটনি মহারাজ সক্কলকেই আদর করে খাওয়াচ্ছেন জড়িবুটি মেশানো অদ্ভুত পাঁচমিশালি আচার। আয়ুর্বেদ সর্বরোগহর ওনার বিশ্বাস। সেখান থেকে আরেকটু এগোলে সিঁড়ির মুখে সিনেমা হলের মতন বিবিধ পোস্টার, বিল্ডিং এর এই দিকের ঘরগুলো বড়োদের দখলে। তাদের রকম সকমই আলাদা, ঘর জোড়া বড়ো বড়ো প্রজেক্ট, ও সমস্ত পোস্টার তার এডভার্টাইজমেন্ট। প্রথম ঘরটা জিওগ্রাফি ডিপার্টমেন্টের, ওদের বিষয় হলো আফ্রিকান সাফারী। ঘরের মাঝখান এ চারটে আর্ট পেপার জুড়ে গর্জন করছে এক ভয়ঙ্কর সুন্দর, কি জীবন্ত! ওরা আবার স্লাইড শো করেছে, মাঝে মাঝে দরজা বন্ধ করে বড়ো স্ক্রিনে দেখাচ্ছে সেরেঙ্গিটির ধূ ধূ প্রান্তর, কিন্তু সেখানে ঢুকতে গেলে তোমাকে লাইন দিতে হবে অনেক ক্ষণ। পাংশুমুখে ঘুরছে কিছু নীল ফুল সোয়েটার আর হাফ প্যান্ট, এক্সিবিশন শেষ হওয়ার আগে কি আর এটা দেখা হবে? সদ্য শো ভেঙে বেরিয়ে আসা কিশোর কৃপাদৃষ্টি দিয়ে চলে যায় অপেক্ষারত লাইনের দিকে। কলেজ স্কোয়ারের জৌলুস নেই হয়তো, শ্রীভূমির লম্বা লাইনও নেই, কিন্তু আমাদেরও প্রতীক্ষা আছে। প্রতীক্ষা অন্তের বিস্ময় আছে। তা ছাড়া আর জীবন কি বলো?
ওখান থেকে বেরিয়ে দেখো ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রির ঘরগুলো। কি ভেবেছ ওরা শুধুই লাল নীল রঙের কেমিক্যাল এক জার থেকে আর এক জারে ঢালবে? দূর দূর ওসব বাচ্ছারা করে। আমরা তো ক্লাস নাইন। দেখো ওরা বলছে মানুষ নাকি কোনোদিনই চাঁদে পা দেয়নি, পুরোটাই আমেরিকার কন্সপিরেসি। আর একটা গোটা ঘর ভরিয়ে ফেলেছে সেই নিয়ে সব তথ্য প্রমাণ লিখে এঁকে। কত জনের প্রজেক্ট জানো? তিরিশ জন মিলে দল বেঁধে প্রায় তিন মাস ধরে সকাল বিকেল খেটে তৈরী করেছে এই সাম্রাজ্য। সেলফ স্টাডিতে সময় মোটে ঘন্টা দুয়েক, তার মধ্যে কেউ ছুটেছে লাইব্রেরিতে, কেউ লিখেছে আর্টিকল, কেউ মেঝেতে চারটে আর্ট পেপার জুড়ে এঁকেছে সেই বিখ্যাত ছবি, চাঁদের বুকে আমেরিকার পতাকা উড়ছে পতপত করে বিনা হাওয়ায়। কেউ বা হয়তো শুধু আঁকার ঘরের দরজাই পাহারা দিয়েছে সারাদিন, যদি সময়ের আগেই বেরিয়ে যায় সমস্ত সিক্রেট? আরেকটু এগোলে দেখতে পাবে একটা ঘর জুড়ে এক দিকে দাঁড়িয়ে লাইফ সাইজ আসিমো আর অন্য দিকে টার্মিনেটর এর শোয়ার্জেনেগার। ওদের প্রজেক্ট হলো রোবট নিয়ে, বুঝেছো নিশ্চই? ডেমন্সট্রেশন দিচ্ছে রামিজ, যে অদ্ভুত দক্ষতায় গত দুই মাস ধরে ম্যানেজ করেছে জনা বিশেকের এই টিম, প্রায় ম্যাজিকের মতন জোগাড় করেছে কম্পিউটার থেকে ইরেজার, যখন যার যা দরকার। আজকে ধরো সে স্বেচ্ছায় ডাক্তার, অন্য দিকে গেলে অনায়াসে মাইক্রোসফট চালাতে পারতো। এক কোণায় দাঁড়িয়ে সদাহাস্য লাজুক সফিকুল, এই ঘরের প্রতিটি বিন্দুতে কোনো না কোনো ভাবে যার অবদান। অথচ কি অদ্ভুত নিরুত্তাপ, ও কি নাসদীয় সূক্তের শেষ পংক্তিগুলি জানে?
ওখান থেকে এবার নিচে নেমে এসো, দেখো লাইফ সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট বানিয়েছে প্রজাপতির জীবনচক্র, রং বেরঙের নানা জাতির ফুল জোগাড় করে এনেছে কে? আর কঙ্কালটা দেখোনি? ওটাই ওদের চিরকালের ট্রাম্প কার্ড। সেখান থেকে টুক করে এগিয়ে এসো একটু হেডমাস্টারের ঘর পেরিয়ে, ইস্কুলের ঠিক মাঝখানে মুখ করে দাঁড়াও। এসেম্বলি হলে ছাত্রদের হাতে আঁকা ছবি সাজানো দেওয়াল ঘিরে, ঠাকুর মা স্বামীজীর ছবি জুড়ে ধূপছায়া আলো, সামনে বহুমূল্য পার্সিয়ান কার্পেটের মতো করে সযত্নে কাটা কাগজ, দীর্ঘ রাত্রি জাগরণের নিবেদন। সামনে মাঠে ধুলো উড়ছে বেমক্কা পদাঘাতে, বেণুদার স্টলে ভিড়। গোটা কোলকাতায় এরকম মোচার চপ পাবেনা আর। দু একটি বিমর্ষ মুখ দেখতে পাচ্ছ কি? ওদের বাড়ি অনেক দুরে, বাবা মা এসে উঠতে পারেননি। পারলে ওদের দুটো এগরোল কিনে দিও। খেয়াল করে দেখো, ক্লাস টেনের ফুলপ্যান্ট অগোছালো দাড়ি ছেলেটির চোখ আটকে গিয়েছে হঠাৎ। নবম শ্রেণীর প্রথম শাড়ি, জড়তা ভাঙেনি এখনো। ছেলেটি তখন প্রথম পড়েছে অভিসার, রাধার কি হইলো অন্তরে ব্যথা। কিন্তু তখনো তাকে কেউ বলে দেয়নি, অভিসার মানে যাওয়া, কিন্তু যাওয়া ঠিক ততটা নয়, যতটা যেতে চাওয়া। সুতরাং সে দেখছে। সতৃষ্ণ দেখছে কিভাবে এলো চুলে ধীরে নেমে আসছে সন্ধ্যা। বিসমিল্লা খান হারিয়ে যাচ্ছেন। পেরিয়ে যাচ্ছেন আলোকোজ্জ্বল ইস্কুল বাড়ি, পেরিয়ে যাচ্ছেন ফাল্গুনী প্রেস, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, পলাশের বন, সারদানন্দ ভবন, লাল রঙা গম্বুজ জলট্যাঙ্কি, ধূ ধূ খোলা মাঠ। বিসমিল্লা হারিয়ে যাচ্ছেন অন্ধকারে। আড়চোখে মেয়েটির দিকে দেখে ছেলেটি পা বাড়াচ্ছে অডিটোরিয়ামের দিকে।
এই আমার নরেন্দ্রপুর। এই আমার নষ্ট কৈশোরের প্রণয়ী শহর। আর এই তার আনন্দযজ্ঞ যেথা সবার নিমন্ত্রণ। কত কিছুই হয়তো পাল্টে গেছে, বহুদিন ফিরে যাইনা তো। একটু ভুল হলো। যেখান থেকে বেরোতেই পারলাম না কোনোদিন, সেখানে আবার ফিরে যাবো কি করে? ভালো থেকো, প্রিয় স্কুল।