Saturday, March 14, 2015

Narendrapur: 2

নরেন্দ্রপুর এর যে কোনো গল্পে অবধারিত ভাবে থাকবেন অজিতদা, মানে অজিত সেনগুপ্ত। দীর্ঘকায়, কৃশ, প্রায় ভয়াবহ দর্শন এই মানুষটি সারা জীবনে যে পরিমাণ শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছেন, ভগবান ও ঈর্ষান্বিত হবেন। অবশ্য মিশনের ছেলেপুলে এমনিতেও ভগবানকে একটু কম সম্মান দিয়ে থাকে। বিরিয়ানি খুবই ভালো খেতে, কিন্তু রোজ সকাল বিকেল খেলে আরসালানেও অরূচি হতে বাধ্য।
অজিতদা পড়াতেন জীবন বিজ্ঞান। আমরা বলতুম বায়োলজি, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ বলত লাইফ সায়েন্স, অজিতদা বলতেন সায়েন্স অফ লাইফ। ফিরে দেখলে মনে হয়, একটু বেশীই মোহগ্রস্ত ছিলাম। আঠারো বছর বয়েস মাথা তোলবার, স্পর্ধা দেখানোর, চোদ্দ অনুসরণের, ব্যক্তিপূজার। শিক্ষক দিবস, আমরা তখন ক্লাস টেন। স্কুলের মেন বিল্ডিং এর সামনের রাস্তায় লাইন করে দাঁড়িয়ে ছেলেরা, মাঝখান দিয়ে নমস্কার এর ভঙ্গিতে হাত দুটো জড়ো করে হেঁটে আসছেন অজিতদা, যেমন অস্কারের রেড কার্পেটে হেঁটে যান ড্যানিয়েল ডে লুইস। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি, মাথা ইষৎ নত, মুখে একটা অদ্ভুত তৃপ্তির হাসি। আমার জীবনের দেখা সেরা দৃশ্য গুলোর মধ্যে একটা। তেরো বছর পরে, আজও চোখের সামনে ছবির মত ভাসে।
অজিতদার হিউমার ছিল শৈল্পিক। এস্পেশালি, পরীক্ষার খাতায়। প্রজাপতির জীবনচক্র আঁকতে গিয়ে একটি ছেলে প্রজাপতিটির উপরে একটু বেশীই পক্ষপাত দেখিয়ে ফেলেছিল। ছেলেটির আঁকার হাত ভালো, ওয়াল ম্যাগাজিনে নিয়মিত ছবি আঁকে, কাঁহাতক আর লার্ভার ছবি আঁকতে ভালো লাগে। খাতা বেরোলে দেখা গেল, অজিতদা সে প্রজাপতির তলায় ভারী সুন্দর অক্ষরে লিখে দিয়েছেন, "শুভ বিবাহ"। আমাদের অনেকেরই ধারণা ছিল, লাইফ সাইন্সে যেকোনো প্রশ্নে ছবি এঁকে দিতে পারলে ভালো নাম্বার পাওয়া যাবে। হৃতপিন্ড রিলেটেড কোন এক প্রশ্নে কেউ একটা ভারী সুন্দর ছবি এঁকেছিল, সময়ের অভাবে নিলয় বা অলিন্দটা পয়েন্ট
করে আসতে পারেনি। খাতায় লেখা ছিল, এ হৃদয় কোত্থেকে এলো, কেনই বা এলো, কার জন্যেই বা এলো।
ছোটবেলা থেকেই ইঁচড়ে পাকা ছিলাম, সুত রাং প্রশ্ন করার অভ্যাস ছিলই। কিন্তু সে প্রশ্নকে অজিতদার মত প্রশ্রয় দেওয়ার লোক বেশী ছিলনা। আমরা যখন বয়ঃসন্ধিতে, তখনও মধ্যশিক্ষা পর্ষদের জীবনশৈলী শিক্ষা শুরু হয়নি। কিন্তু প্রতিভা ও ছোটভাই কে চেপে রাখা যায়না, সময় হলে তারা ফুঁড়ে বেরোবেই। সুতরাং, আমাদের মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি, এবং মেয়েদের অভাবে কিছু কলি পথভ্রষ্ট হয়ে ভুল পথে যাচ্ছে, মহারাজদের উপরেই দ্বায়িত্ব পড়ল সে সব সামলানোর। উদ্দেশ্য মহৎ সন্দেহ নেই, একসিকিউশনে কিছু প্রবলেম দেখা যেত। একজন মহারাজ ছিলেন খুবই স্ট্রেট ফরওয়ার্ড, শোনা যায় ছেলেদের ডেকে জিজ্ঞেস করতেন, "এই ছেলে তোমার হয়"? একটি ছেলে ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বলেছিল, হ্যান হয় তো। মহারাজের ছেলেটির হাবভাব দেখে সন্দেহ হয়, অতঃপর, "কি রঙের বলতো"? ছেলেটির ছোট্ট উত্তর আজও ইতিহাস: "বেগুনি"। এই মহান প্রচেষ্টা যে খুব বেশী কার্যকরী হয়নি, বলাই বাহুল্য।
এই ছোট্ট ডিটুরের কারণ একটু পরেই পরিষ্কার হবে। মিশনের জীবনশৈলী শিক্ষার মূল বক্তব্য ছিল ব্রহ্মচর্য। এমনি এমনি এ কথা বাজারে আসেনি যে নরেন্দ্রপুরের খাদ্য আলুময়, জীবন ঘন্টাময় ও চিন্তা ব্রহ্মময় । অবশ্য দুর্জনে বলেই থাকে চরিত্র হল সাহস ও সুযোগের অভাব। যাকগে, যে কথা হচ্ছিল। মূল বক্তব্য ছিল, মনকে পরিষ্কার রাখতে হবে, এবং রেতঃক্ষরণ মহাপাপ। মহারাজদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, আঠারো বছর অধঃপতন না হলে ইয়ে উর্ধ্বগামী হয়ে কূলকুন্ডলিনীতে সুড়সুড়ি দেয় এবং সেই চাপে মানুষ ব্যাটম্যান হয়ে যায়, একথা স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব বলে গেছেন। বিশ্বাস না হয় কথামৃত খুলে দেখতে পারেন। কিন্তু কিছু ব্যথা থাকেই, তীব্র জাতের, কিছু কিছু ব্যথা থাকেই, মধ্যরাতের। সুতরাং অজিতদাকে জিজ্ঞেস করা হলো। মৃদু হেসে অজিতদা বললেন, ওটাকে যারা বীর্য নাম দিয়েছে, তাদের উপর আমার করুণা হয়। শোন, জন্মিলে মরিতে হবে, এটা মানুষের জন্য যেমন সত্য, স্পার্মের জন্যেও। তুই না মারলে, নিজেই মরবে। সুতরাং, ক্লৈব্যম মা স্ম গমঃ পার্থ। ওই ভীষণ অপাপবিদ্ধ পরিবেশ, যেখানে কান পাতলে বাঁশ ঝাড়ে ঝাড়ে ওম ওম ধ্বনি শোনা যায়, সেখানে দাঁড়িয়ে এই কথা বলতে সাহস লাগে স্যার।
আগেই বলেছি স্টাডি হলগুলো ছিল যত অপকর্মের জায়গা। তখন আমরা ক্লাস টেনে, লাইফ সাইন্সে ব্যাং ইত্যাদির জনন পড়ছি, এবং পড়াচ্ছেন অজিতদা। সন্দেহ নেই খুব জোরদার পড়া হচ্ছে। এখন ভাবলে ভয়াবহ অবাক লাগে, একদিন সন্ধেবেলা আমি একটা মশাকে ধরে আতস কাঁচ দিয়ে তার গোপনাঙ্গ খুঁজেছিলাম। পাওয়া যায়নি। পরের দিন ক্লাসের শেষ, অজিতদা হন হন করে বেরোচ্ছেন, আমি হাত তুললাম, স্যার, মশা কি যৌন জনন করে? থেমে গিয়ে অজিতদা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন, কেন? না অজিতদা কালকে সারা সন্ধে ধরে খুঁজেও ওটা দেখতে পেলাম না। দু মিনিট দাঁড়িয়ে ধুতিটা হাঁটুর কাছে তুলে আনলেন, তারপর সেই প্রশ্রয়মিশ্রিত দাঁতখিঁচুনি, আমারটা দেখতে পাচ্ছিস? সন্দেহ আছে, আমি যৌন জনন করি?
অজিতদা মারা গেছেন, তাও আজ চার বছর হয়ে গেল। কঠিন হাঁপানির রোগ ছিল, জেনেটিক। সেই বিষ আর পরের প্রজন্মে যেতে দেবেন না বলে বিয়ে করেননি, এক পালিতা কন্যা ছিলেন, বাপ বেটিতে থাকতেন নরেন্দ্রপুরের সামনেই। স্কুল ছেড়ে আসার পরে দু একবার দেখা হয়েছে, যতবারই প্রণাম করেছি, বলেছেন, শোন পারলে পড়াস। আমাদের ওয়েল্টন একাডেমির কৌলিন্য ছিলোনা, পাশের স্কুলে বুকে কাঁপন ধরানো শমিতা শেট্টি ছিলনা, কিন্তু নিয়ম ভাঙ্গার স্পর্ধা ছিল, আর তাতে প্রশ্রয় দেওয়ার অজিতদা ছিলেন। তিনিই ছিলেন আমাদের ডেড পোয়েট সোসাইটির রবিন উইলিয়ামস, মহব্বতের শাহরুখ খান। মৃত্যুর পরে কিছু থাকেনা জানি, তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, ফর্সা ধুতি পাঞ্জাবির দীর্ঘকায়, দাঁত উঁচু সেই
মানুষটি দূর থেকে লক্ষ্য রাখছেন, জীবনের বিজ্ঞান কতটা বুঝলাম। ভালো থাকবেন, অজিতদা। ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন।

Narendrapur: 1

নরেন্দ্রপুর নিয়ে দুকলম লিখে যাই। প্রথম নাম মনে আসছে নাড়ুর। নারায়ণ
মহারাজ, যোগানন্দ ভবনে থাকতেন। বিপাশা বসুর হাস্কিনেসের  সাথে অমিতাভ
বচ্চনের গাম্ভীর্য মেলালে অমন গলা হয়। গরমকালে ফ্যান চালালে কেন ঘাম
শুকিয়ে যায়? ফিজিক্সের একটা কমন ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু নাড়ুর একটা
বায়োলজিকাল বক্তব্য ছিল। পাখার হাওয়া ত্বকের উপর প্রেশার দিয়ে ঘামটা
ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। আরো কিছু মণি মুক্তো ছিল, পরে বলা যাবে।

আর একজন ছিলেন সুনীতিদা, বাংলা পড়াতেন। আজ অবধি অমন ভালো হাতের লেখা
দেখিনি। তেমনি মারতেন। স্টাডি হল বলে একটা জায়গা ছিল প্রত্যেকটা
হোস্টেলে, সেখানে দল বেঁধে পড়াশুনো করার কথা সকাল ৬টা থেকে ৮টা অব্দি,
কিন্তু সবাই ঘুমোতো। ন্যাচারাল ব্যাপার। সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠলে
মানুষ সন্ন্যাসী বা পারভার্ট হয়ে যায়।  এই স্টাডি হল গুলোতে একজন স্যার
আসতেন, যাঁদের কাজ ছিল প্রাইমারিলি  ছেলেপুলে কে ঘুম থেকে তোলা। বেশীর
ভাগ স্যারই দাঁড় করিয়ে দিতেন, এবং বছর তিনেকের মধ্যে দেখলুম সকলেই
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমনোর ব্যাপারটা বেশ অভ্যাস করে ফেলেছে। সেই থেকে আমি
ডারউইন এর তত্বে বিশ্বাসী হয়ে উঠি, এবং প্রেয়ার হলে ঘুমোনো অভ্যাস করে
ফেলি। সুনীতিদা শুধু দাঁড় করানোয় বিশ্বাস রাখতেন না। ডেস্কে মাথা রেখে
শান্তিতে ঘুমোচ্ছে, এমন জোয়ান মদ্দ ছেলেকে, বললে বিশ্বাস করবেন না, জুলপি
ধরে, জাস্ট জুলপি ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে  দিতেন। তারপরে পড়াশুনো হোক বা না
হোক, যন্ত্রণার চোটে ঘুমোনো আর সম্ভব হতোনা।

এই সুনীতিদা "স" বর্ণটা অদ্ভুত ভাবে উচ্চারণ করতেন। ব্যাপারটা ছিল অনেকটা
স,জ আর ঝ এর মিশ্রণ। আমরা আড়ালে বলতুম জঝ্যানীতি। খুবই গম্ভীর প্রকৃতির
লোক, চুপচাপ থাকেন। একদিন স্টাডি হল বেশ শান্ত, সুনীতিদার পাশের ডেস্কে
বসে একটি ছেলে উদাস হয়ে সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাত দেখে
দেওয়াল বেয়ে একটা টিকটিকি উঠছে। ছেলেটি চটি খুলে মোক্ষম টিপ করতে যাবে,
সুনীতিদা চেয়ার থেকে প্রায় ধুমকেতুর স্পীডে লাফিয়ে উঠলেন, "খবরদার,
স্ট্যাকটিকির গায়ে কেউ হাআআত দেবেনা"। এই অলৌকিক ঘটনার আজ অব্দি কোনো
কারণই খুঁজে পাইনি।

আলাভোলা টিকটিকি প্রেমী স্যারেরা ছিলেন, ভালো মন্দ বিজ্ঞানী অজ্ঞানী
গেরুয়া সাদা মহারাজেরা ছিলেন,  সন্ধের ঘুম জড়িয়ে আসা চোখে শাঁখের আওয়াজ
ছিল, পাশের মোল্লাপাড়া থেকে ভেসে আসা অপার্থিব চিত্কার ছিল, অদ্ভুত নিয়ম
ছিল, সেই নিয়ম ভাঙ্গার আনন্দ ছিল, সব মিলিয়ে নরেন্দ্রপুর বড় মায়াময় ছিল।
পিছন ফিরে দেখলে রূপকথা মনে হয়।