Thursday, November 26, 2015

আলাস্কা-১


“Some people never go crazy. What truly horrible lives they must lead.”

বারাসাতের এক অজ পাড়া গাঁয়ে আমাদের বাড়ি। বারাসাতের বাসিন্দারা জানবেন,  সেখানে আবহাওয়া এবং ইলেকট্রিক অফিস এক মারাত্মক সমন্বয়ে কাজ করে, গ্রীষ্মকালে টেম্পারেচার আর লোডশেডিং এর দৈর্ঘ্য সমানুপাতে বাড়তেই থাকে বাড়তেই থাকে। সেই দুর্ধর্ষ ভ্যাপসা গরমে প্রায় অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় আকবরের দাক্ষিণাত্য নীতি মুখস্থ করে করে যার অর্ধেক জীবন কেটেছে, তার কাছে আলাস্কা যাওয়া এবং চাঁদে যাওয়া, মোটের উপর একই ব্যাপার।

তো বছর দুয়েক আগে, সেই স্বপন কুমারের গল্পের মত, কি হইতে কি হইয়া গেল, এ বাঙাল গিয়ে হাজির হলো আলাস্কায়। এবং একলাটি নয়, দল বল শুদ্ধু। সেই গল্প বলার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের। আসলে এই রোমন্থন শুধু নিজেকেই ফিরে দেখার চেষ্টা, প্রায় স্বপ্নের মত কাটানো সাত দিন পুনর্বপনের চেষ্টা। আর যাত্রা তো শুধু যাত্রা নয়, তাতে স্ক্যান্ডাল আছে, বুড়ি ছোঁয়া প্রেম আছে, মান অভিমান আছে, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার রোমাঞ্চ আছে, সব মিলিয়ে একটা অন্য পৃথিবীর গল্প আছে। কবি বলেছেন, তোমার অভিসারে যাব অগম পারে। আর কেই বা না জানে, অভিসার মানে যাওয়া, কিন্তু যাওয়া ঠিক ততটা নয়, যতটা যেতে চাওয়া। এই গল্প তেমনই এক অভিসারের গল্প হয়ে উঠুক, বাক্যে লেগে থাক সুখী গৃহিণীর অতৃপ্তির স্বেদবিন্দু, যাতে বার বার ফিরে গিয়েও পথ সতত অসম্পূর্ণ থাকে। রম্যাণী বীক্ষ্য।

পূর্বরাগ কিংবা ভূত দর্শন
--------------------------
আলাস্কা যাত্রা কিছু পরমব্রহ্ম বা বিগব্যাং নয় যে তার শুরু শেষ থাকবেনা, সুতরাং শুরুর থেকেই শুরু করা যাক। এখন আমরা যেখানে থাকি, সেটি আমেরিকার ইস্ট কোস্টে একটি ছোট গ্রাম বিশেষ, যাকে সাহেবী কায়দায় কলেজ টাউন বলা হয়। এইটুকু ছোট্ট জায়গাতেও প্রচুর বাঙালী, আমাদের নিজেদের দুর্গা পুজো হয়, মায় সরস্বতী পুজোতে পর্যন্ত নাটক মঞ্চে তোলা হয় (মঞ্চস্থ বললে অপমান হবে)। সব মিলিয়ে এক ভারী জমাটি ঘরোয়া পরিবেশ। ভদ্র ঘরের নিতান্ত ভেতো বাঙালি আমরা, সপ্তাহান্তে জড়ো হয়ে মদ খাই, পলিটিক্স আলোচনা করি এবং রবীন্দ্র সঙ্গীত গাই। এভাবেই বেশ কেটে যাচ্ছিল দিন কাল।  হঠাত অক্টোবর এর এক রাত্রে কি যে হইলো জানে শ্যামলাল, আমাদের মাথায় চাগাড় দিয়ে উঠলো যে ভূত দেখতে যেতে হবে।  ভূত বাড়ির পাশেই দেখা যায়, ঠিক পাশে নয়, মাইল পঞ্চাশ যেতে হয়, তা আম্রিগার রাস্তায় পঞ্চাশ মাইল আর কি এমন ব্যাপার। সদলবলে পাঁচটি গাড়ি বোঝাই করে আমরা চললুম ভূত দেখতে। একটা পুরনো দিনের পরিত্যক্ত রেলগেট, সেইটা ক্রস করে একটা ভাঙ্গাচোরা রাস্তা, সেইখানে নাকি শন শন হাওয়া বয় মাঝরাতে আর সাদা গাউন পরা একটি মেয়ে রাস্তা জুড়ে ভেসে বেড়ায়। ভারী থ্রিলিং ব্যাপার।

তাপ্পর যা হওয়ার তাই হলো আর কি। ভূতের দেখা নাই রে, ভূতের দেখা নাই। বিভূতিভূষণের তারানাথ তান্ত্রিকের গল্পে আছে কেমন ঘোরতর সাধনা করে, অমবস্যার শ্মশানে পঞ্চমুন্ড আসনে বসে হ্রীং ক্লিং মন্ত্র পড়ে তাঁর দর্শন পাওয়া যায়। এমন পিকনিক পার্টির ঘোরতর হই হট্টগোলের মাঝখানে তিনি থোড়াই দেখা দেবেন, তা তিনি যতই ম্লেচ্ছ ভূত হোন না কেন! মাঝখান থেকে আমরা ওই জন মানবহীন রাস্তার উপরে খানিক লুঙ্গি ড্যান্স নেচে নিলুম। সত্যি কথা বলতে কি, ভূত যদি থেকেও থাকেন, আমি নিশ্চিত সেই দিনের গন্ডগোলের পর থেকে তিনি ওখান থেকে পাত্তারি গুটিয়েছেন। সাহেবী ভূতের এমন বাঙালি এক্সর্সিসম এর নিদর্শন বেশী আছে বলেতো মনে হয়না।

সে কথা থাক, ভূত দেখতে না পেয়ে আমরা তো ভারী বিমর্ষ, প্রায় হতোদ্যম হয়ে ফিরে আসছি। গাড়ির মধ্যেই প্রায় ভৌতিক নৈশব্দ্য। এমন সময়, হঠাতই একজন বলে উঠলো,
"চল আলাস্কা যাই".
"আলাস্কা যাবি? কবে?"
"কেন, ডিসেম্বরে? ২৫শে ডিসেম্বরে তো এক হপ্তা ছুটি পাওয়াই যাচ্ছে।"
"ডিসেম্বরে আলাস্কা যাবি? তোকে ভুতে ধরেনি তো? ওখানে তখন -৪০ ডিগ্রি টেম্পারেচার। পাগলা আইসক্রিম খাবি কি, নিজেই তো হয়ে যাবি!"
"হ্যান, ইয়ে জাস্ট ফ্রিজ করে যাবে ভাই, টাকে ওঠারও সুযোগ পাবেনা।"
"সে তোরা যাই বল, একবার চেষ্টা করতে ক্ষতি কি? আর তা ছাড়া ডিসেম্বরে গেলে অরোরা বোরীয়লিস দেখার দারুন চান্স আছে। "

এইবারে সবাই একটু নড়ে চড়ে বসলো। আহা! অরোরা বোরীয়লিস! সেই আকাশ জুড়ে অদ্ভুত রঙের খেলা, ছোট্ট বেলা থেকে যার এত ছবি দেখে এসেছি! সে জিনিস কি চর্মচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হবে? হলেতো মন্দ হয়না। সুতরাং, বিভিন্ন গাড়ি জুড়ে কনফারেন্স কল করা শুরু হলো।

সমস্ত মহান মানুষের মধ্যেই কিছু মাত্রায় পাগলামি থেকে থাকে। নাকি পাগলামি সবারই মধ্যে থাকে কিছু লোক সেটাকে কাজে লাগিয়ে মহান হয়ে যান। এই কুতর্কে না গিয়েই বলা যায়, অক্টোবর এর এক মধ্যরাত্রে, কিছু ঘরকুনো, ভেতো ও ভীতু বাঙালি হঠাত কি এক আজব পাগলামির খেয়ালে ঠিক করে বসলো যে ডিসেম্বরের হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় আলাস্কার গ্লেসিয়ারের উপরে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটি তারা দেখবেই। ফিরে দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়, কেমন যেন রূপকথা মনে হয়।  ভূত দেখা হয়নি আমাদের, কিন্তু সত্যিই কি তাই? আমেরিকা জুড়ে এত জায়গা থাকতে, আলাস্কার কথাটাই যে প্রথম মনে এলো, একি কম ভৌতিক ব্যাপার? হয়ত বা সাদা গাউনের মেয়েটি সেই রাস্তা জুড়ে এলোমেলো ভাবে ছেয়ে ছিল, যার সাথে আমাদের অনেকবার দেখা হবে মাস দুয়েকের মধ্যেই। সে গল্প ক্রমশঃ প্রকাশ্য। 

No comments: