পুরোনো জিনিস নিয়ে আমার মধ্যে বিশেষ রোমান্টিকতা নেই। পুরনো যা, কালের নিয়মে সরে যাবে, এটাই নিয়ম, বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপার। তবু যখন আকাশ মেঘলা করে আসে, আর কবীর সুমন গেয়ে ওঠেন, "মন খারাপ করা বিকেল মানেই মেঘ করেছে", ইচ্ছে করে সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাই। বারাসাতের সেই ছোট্ট বাড়ির জানলা দিয়ে দেখছি জল পড়ছে বাইরে, আর অন্ধকারের মধ্যে মা মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়ে আসছে, এর কাছে এত আলো, এত উচ্ছাস, এত প্রাচুর্য বড় দীন মনে হয়। যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন, সেই খানে যে চরণ তোমার রাজে।
সমরেশ মজুমদার দেখলাম পত্রিকায় লিখেছেন চিঠি নিয়ে। লেখাটা শুরু হয়েছে এই ভাবে, "মা আমার খুব কস্ট হচ্ছে" । পুরোটা পড়া হয়নি, প্রথম লাইনটা এমন ধক করে বুকে লাগলো, আর এগোনই হলনা। সেই ছোট্ট ছেলেটির কথা মনে পড়ে গেল। নরেন্দ্রপুরের ঘর গুলো জেলখানার মত ছিলনা, কিন্তু দশ বছরের একটা ছেলের কাছে বাবা মা ছাড়া যেকোনো জায়গাই বোধ হয় সেরকম। মধ্যবিত্ত ঘরে ফোন জিনিসটাই তখন ছিল প্রায় দুষ্প্রাপ্য, আর নরেন্দ্রপুরতো আরেক কাঠি ওপরে। ঘরে সিলিং ফ্যান অব্দি ছিলনা, ফোনের কথাতো ভাবাই যায়না। দু তিন সপ্তাহ অন্তর তিন ঘন্টার জন্যে বাবা মার সঙ্গে একবার দেখা, এছাড়া যোগাযোগের মাধ্যম বলতে একমাত্র চিঠি। এখনো মনে আছে, বাইরে বৃষ্টি পড়লে একটা পোস্ট কার্ড নিয়ে বসতাম, হাবি জাবি আঁকি বুঁকি আর শেষে একটি কথা, "মা, আমার মন ভালো নেই, আমি বাড়ি যাবো" । কত সেরকম চিঠি অর্ধেক লিখে ফেলে দিয়েছি, আর পোস্ট করা হয়নি। শুধু একটি চিঠি শেষ করেছিলাম, সেদিন তুলকালাম বৃষ্টি বাইরে, জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজেছিলাম। না, জলের ছাঁটে নয়। অনেক পরে যখন শক্তির কবিতায় পড়ি, "ভারী ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে", বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি।
তারে জমিন পর দেখতে গেছিলাম প্রিয়ায়, বন্ধুদের সাথে। বাবা মাও দেখতে গেছিল পরে, অর্ধেক দেখে বেরিয়ে এসেছিল, নোনা জল বড় অস্বস্তির। তো আমি দেখলাম দর্শিল সাফারির কান্না, হাসতে হাসতে, বন্ধুদের সাথে খিল্লি করতে করতে, বুকের ভেতর পুড়তে পুড়তে। ছেলেদেরতো কাঁদতে নেই। তখন চিঠি লেখার দিন চলে গেছে, আমরা অর্কুট ফেসবুকে "ভাটাই"। ভালোবাসা, মন্দবাসা, নিষ্ফল দিনযাপন, সব অনলাইন। সে দিনও মনে বড্ড মনে পড়েছিলো জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছেলেটির কথা, যে কেবলই লিখছে আর ছিঁড়ে ফেলছে তার দুঃসহ দিনলিপি। তারপর যা হয়, না বলা কথারা ডুবে যায়।
এখনতো অনেক বড় হয়ে গেছি, এ প্রবাস, এ দূরত্ব সকলই স্বেচ্ছার। তবু মাঝে মাঝে বড় ইচ্ছে হয়, এক খানি চিঠি লিখে পোস্ট করে দিই, মা, আমার মন ভালো নেই, আমি বাড়ি যাবো। আর সাত সাগর পেরিয়ে কেউ এসে নিয়ে যাবে আমাকে।
No comments:
Post a Comment