Thursday, December 10, 2015

দয়িতা কে

প্রেম অপ্রেম। কিছু কাটাকুটি খেলা।
ঝাপসা স্মৃতিরা। আর মেঘলা বিকেলবেলা।
এলোমেলো কিছু কথা। কিছু নিরুদ্দেশ।
আধখোলা ভিজে চুলে মাখা আশ্লেষ।
কিছু চোখ বাঙ্ময়। অতল ও গহন।
না খোলা বিবর্ণ খাম। কিছু স্তব্ধ উচ্চারণ।
কিছু বুক কুরে খাওয়া। নিঃশব্দ দহনে।
ভ্রূপল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে।

তোকে ভালোবাসি। মুমূর্ষু কবিতার মত।
জীর্ণ যা কিছু, পুরোনো মলিন,
ধুয়ে যাক যত।    

Wednesday, December 9, 2015

চিঠি কিংবা না হওয়া কবিতারা

পুরোনো জিনিস নিয়ে আমার মধ্যে বিশেষ রোমান্টিকতা নেই। পুরনো যা, কালের নিয়মে সরে যাবে, এটাই নিয়ম, বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপার। তবু যখন আকাশ মেঘলা করে আসে, আর কবীর সুমন গেয়ে ওঠেন, "মন খারাপ করা বিকেল মানেই মেঘ করেছে", ইচ্ছে করে সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাই। বারাসাতের সেই ছোট্ট বাড়ির জানলা দিয়ে দেখছি জল পড়ছে বাইরে, আর অন্ধকারের মধ্যে মা মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়ে আসছে, এর কাছে এত আলো, এত উচ্ছাস, এত প্রাচুর্য বড় দীন মনে হয়। যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন, সেই খানে যে চরণ তোমার রাজে।
সমরেশ মজুমদার দেখলাম পত্রিকায় লিখেছেন চিঠি নিয়ে। লেখাটা শুরু হয়েছে এই ভাবে, "মা আমার খুব কস্ট হচ্ছে" । পুরোটা পড়া হয়নি, প্রথম লাইনটা এমন ধক করে বুকে লাগলো, আর এগোনই হলনা। সেই ছোট্ট ছেলেটির কথা মনে পড়ে গেল। নরেন্দ্রপুরের ঘর গুলো জেলখানার মত ছিলনা, কিন্তু দশ বছরের একটা ছেলের কাছে বাবা মা ছাড়া যেকোনো জায়গাই বোধ হয় সেরকম। মধ্যবিত্ত ঘরে ফোন জিনিসটাই তখন ছিল প্রায় দুষ্প্রাপ্য, আর নরেন্দ্রপুরতো আরেক কাঠি ওপরে। ঘরে সিলিং ফ্যান অব্দি ছিলনা, ফোনের কথাতো ভাবাই যায়না। দু তিন সপ্তাহ অন্তর তিন ঘন্টার জন্যে বাবা মার সঙ্গে একবার দেখা, এছাড়া যোগাযোগের মাধ্যম বলতে একমাত্র চিঠি। এখনো মনে আছে, বাইরে বৃষ্টি পড়লে একটা পোস্ট কার্ড নিয়ে বসতাম, হাবি জাবি আঁকি বুঁকি আর শেষে একটি কথা, "মা, আমার মন ভালো নেই, আমি বাড়ি যাবো" । কত সেরকম চিঠি অর্ধেক লিখে ফেলে দিয়েছি, আর পোস্ট করা হয়নি। শুধু একটি চিঠি শেষ করেছিলাম, সেদিন তুলকালাম বৃষ্টি বাইরে, জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজেছিলাম। না, জলের ছাঁটে নয়। অনেক পরে যখন শক্তির কবিতায় পড়ি, "ভারী ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে", বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি।
তারে জমিন পর দেখতে গেছিলাম প্রিয়ায়, বন্ধুদের সাথে। বাবা মাও দেখতে গেছিল পরে, অর্ধেক দেখে বেরিয়ে এসেছিল, নোনা জল বড় অস্বস্তির। তো আমি দেখলাম দর্শিল সাফারির কান্না, হাসতে হাসতে, বন্ধুদের সাথে খিল্লি করতে করতে, বুকের ভেতর পুড়তে পুড়তে। ছেলেদেরতো কাঁদতে নেই। তখন চিঠি লেখার দিন চলে গেছে, আমরা অর্কুট ফেসবুকে "ভাটাই"। ভালোবাসা, মন্দবাসা, নিষ্ফল দিনযাপন, সব অনলাইন। সে দিনও মনে বড্ড মনে পড়েছিলো জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছেলেটির কথা, যে কেবলই লিখছে আর ছিঁড়ে ফেলছে তার দুঃসহ দিনলিপি। তারপর যা হয়, না বলা কথারা ডুবে যায়।
এখনতো অনেক বড় হয়ে গেছি, এ প্রবাস, এ দূরত্ব সকলই স্বেচ্ছার। তবু মাঝে মাঝে বড় ইচ্ছে হয়, এক খানি চিঠি লিখে পোস্ট করে দিই, মা, আমার মন ভালো নেই, আমি বাড়ি যাবো। আর সাত সাগর পেরিয়ে কেউ এসে নিয়ে যাবে আমাকে।

Thursday, November 26, 2015

আলাস্কা-১


“Some people never go crazy. What truly horrible lives they must lead.”

বারাসাতের এক অজ পাড়া গাঁয়ে আমাদের বাড়ি। বারাসাতের বাসিন্দারা জানবেন,  সেখানে আবহাওয়া এবং ইলেকট্রিক অফিস এক মারাত্মক সমন্বয়ে কাজ করে, গ্রীষ্মকালে টেম্পারেচার আর লোডশেডিং এর দৈর্ঘ্য সমানুপাতে বাড়তেই থাকে বাড়তেই থাকে। সেই দুর্ধর্ষ ভ্যাপসা গরমে প্রায় অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় আকবরের দাক্ষিণাত্য নীতি মুখস্থ করে করে যার অর্ধেক জীবন কেটেছে, তার কাছে আলাস্কা যাওয়া এবং চাঁদে যাওয়া, মোটের উপর একই ব্যাপার।

তো বছর দুয়েক আগে, সেই স্বপন কুমারের গল্পের মত, কি হইতে কি হইয়া গেল, এ বাঙাল গিয়ে হাজির হলো আলাস্কায়। এবং একলাটি নয়, দল বল শুদ্ধু। সেই গল্প বলার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের। আসলে এই রোমন্থন শুধু নিজেকেই ফিরে দেখার চেষ্টা, প্রায় স্বপ্নের মত কাটানো সাত দিন পুনর্বপনের চেষ্টা। আর যাত্রা তো শুধু যাত্রা নয়, তাতে স্ক্যান্ডাল আছে, বুড়ি ছোঁয়া প্রেম আছে, মান অভিমান আছে, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার রোমাঞ্চ আছে, সব মিলিয়ে একটা অন্য পৃথিবীর গল্প আছে। কবি বলেছেন, তোমার অভিসারে যাব অগম পারে। আর কেই বা না জানে, অভিসার মানে যাওয়া, কিন্তু যাওয়া ঠিক ততটা নয়, যতটা যেতে চাওয়া। এই গল্প তেমনই এক অভিসারের গল্প হয়ে উঠুক, বাক্যে লেগে থাক সুখী গৃহিণীর অতৃপ্তির স্বেদবিন্দু, যাতে বার বার ফিরে গিয়েও পথ সতত অসম্পূর্ণ থাকে। রম্যাণী বীক্ষ্য।

পূর্বরাগ কিংবা ভূত দর্শন
--------------------------
আলাস্কা যাত্রা কিছু পরমব্রহ্ম বা বিগব্যাং নয় যে তার শুরু শেষ থাকবেনা, সুতরাং শুরুর থেকেই শুরু করা যাক। এখন আমরা যেখানে থাকি, সেটি আমেরিকার ইস্ট কোস্টে একটি ছোট গ্রাম বিশেষ, যাকে সাহেবী কায়দায় কলেজ টাউন বলা হয়। এইটুকু ছোট্ট জায়গাতেও প্রচুর বাঙালী, আমাদের নিজেদের দুর্গা পুজো হয়, মায় সরস্বতী পুজোতে পর্যন্ত নাটক মঞ্চে তোলা হয় (মঞ্চস্থ বললে অপমান হবে)। সব মিলিয়ে এক ভারী জমাটি ঘরোয়া পরিবেশ। ভদ্র ঘরের নিতান্ত ভেতো বাঙালি আমরা, সপ্তাহান্তে জড়ো হয়ে মদ খাই, পলিটিক্স আলোচনা করি এবং রবীন্দ্র সঙ্গীত গাই। এভাবেই বেশ কেটে যাচ্ছিল দিন কাল।  হঠাত অক্টোবর এর এক রাত্রে কি যে হইলো জানে শ্যামলাল, আমাদের মাথায় চাগাড় দিয়ে উঠলো যে ভূত দেখতে যেতে হবে।  ভূত বাড়ির পাশেই দেখা যায়, ঠিক পাশে নয়, মাইল পঞ্চাশ যেতে হয়, তা আম্রিগার রাস্তায় পঞ্চাশ মাইল আর কি এমন ব্যাপার। সদলবলে পাঁচটি গাড়ি বোঝাই করে আমরা চললুম ভূত দেখতে। একটা পুরনো দিনের পরিত্যক্ত রেলগেট, সেইটা ক্রস করে একটা ভাঙ্গাচোরা রাস্তা, সেইখানে নাকি শন শন হাওয়া বয় মাঝরাতে আর সাদা গাউন পরা একটি মেয়ে রাস্তা জুড়ে ভেসে বেড়ায়। ভারী থ্রিলিং ব্যাপার।

তাপ্পর যা হওয়ার তাই হলো আর কি। ভূতের দেখা নাই রে, ভূতের দেখা নাই। বিভূতিভূষণের তারানাথ তান্ত্রিকের গল্পে আছে কেমন ঘোরতর সাধনা করে, অমবস্যার শ্মশানে পঞ্চমুন্ড আসনে বসে হ্রীং ক্লিং মন্ত্র পড়ে তাঁর দর্শন পাওয়া যায়। এমন পিকনিক পার্টির ঘোরতর হই হট্টগোলের মাঝখানে তিনি থোড়াই দেখা দেবেন, তা তিনি যতই ম্লেচ্ছ ভূত হোন না কেন! মাঝখান থেকে আমরা ওই জন মানবহীন রাস্তার উপরে খানিক লুঙ্গি ড্যান্স নেচে নিলুম। সত্যি কথা বলতে কি, ভূত যদি থেকেও থাকেন, আমি নিশ্চিত সেই দিনের গন্ডগোলের পর থেকে তিনি ওখান থেকে পাত্তারি গুটিয়েছেন। সাহেবী ভূতের এমন বাঙালি এক্সর্সিসম এর নিদর্শন বেশী আছে বলেতো মনে হয়না।

সে কথা থাক, ভূত দেখতে না পেয়ে আমরা তো ভারী বিমর্ষ, প্রায় হতোদ্যম হয়ে ফিরে আসছি। গাড়ির মধ্যেই প্রায় ভৌতিক নৈশব্দ্য। এমন সময়, হঠাতই একজন বলে উঠলো,
"চল আলাস্কা যাই".
"আলাস্কা যাবি? কবে?"
"কেন, ডিসেম্বরে? ২৫শে ডিসেম্বরে তো এক হপ্তা ছুটি পাওয়াই যাচ্ছে।"
"ডিসেম্বরে আলাস্কা যাবি? তোকে ভুতে ধরেনি তো? ওখানে তখন -৪০ ডিগ্রি টেম্পারেচার। পাগলা আইসক্রিম খাবি কি, নিজেই তো হয়ে যাবি!"
"হ্যান, ইয়ে জাস্ট ফ্রিজ করে যাবে ভাই, টাকে ওঠারও সুযোগ পাবেনা।"
"সে তোরা যাই বল, একবার চেষ্টা করতে ক্ষতি কি? আর তা ছাড়া ডিসেম্বরে গেলে অরোরা বোরীয়লিস দেখার দারুন চান্স আছে। "

এইবারে সবাই একটু নড়ে চড়ে বসলো। আহা! অরোরা বোরীয়লিস! সেই আকাশ জুড়ে অদ্ভুত রঙের খেলা, ছোট্ট বেলা থেকে যার এত ছবি দেখে এসেছি! সে জিনিস কি চর্মচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হবে? হলেতো মন্দ হয়না। সুতরাং, বিভিন্ন গাড়ি জুড়ে কনফারেন্স কল করা শুরু হলো।

সমস্ত মহান মানুষের মধ্যেই কিছু মাত্রায় পাগলামি থেকে থাকে। নাকি পাগলামি সবারই মধ্যে থাকে কিছু লোক সেটাকে কাজে লাগিয়ে মহান হয়ে যান। এই কুতর্কে না গিয়েই বলা যায়, অক্টোবর এর এক মধ্যরাত্রে, কিছু ঘরকুনো, ভেতো ও ভীতু বাঙালি হঠাত কি এক আজব পাগলামির খেয়ালে ঠিক করে বসলো যে ডিসেম্বরের হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় আলাস্কার গ্লেসিয়ারের উপরে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটি তারা দেখবেই। ফিরে দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়, কেমন যেন রূপকথা মনে হয়।  ভূত দেখা হয়নি আমাদের, কিন্তু সত্যিই কি তাই? আমেরিকা জুড়ে এত জায়গা থাকতে, আলাস্কার কথাটাই যে প্রথম মনে এলো, একি কম ভৌতিক ব্যাপার? হয়ত বা সাদা গাউনের মেয়েটি সেই রাস্তা জুড়ে এলোমেলো ভাবে ছেয়ে ছিল, যার সাথে আমাদের অনেকবার দেখা হবে মাস দুয়েকের মধ্যেই। সে গল্প ক্রমশঃ প্রকাশ্য। 

Monday, April 13, 2015

অঞ্জন দত্ত Anjan Dutta

অঞ্জন দত্তের গান ভালো লাগে, এই নিয়ে খুব ভয়ে ভয়ে থাকি। কাউকে বলতে পারিনা। মানে রবীন্দ্রসঙ্গীত, চন্দ্রবিন্দু, সুমনের গান ভালো লেগেও যে ওটা মোটামুটি ভালো লাগা যায়, এইটা লোকজন বিশ্বাস করতে চায়না। আজ সাহস করে বলে দিলাম। ক্যাথার্সিস।

 আমি সুর বুঝিনা, অলমোস্ট একেবারেই না।  সুতরাং গান শোনাটা প্যাশনের দিক থেকে।  আমার নয়, শিল্পীর প্যাশন। এই ব্যাপারটা আমি ঠিক বলে বোঝাতে পারবোনা। কনেক্ট করা বললে কাছাকাছি যাবে বোধ হয়। কন্ঠ, সুর, লিরিক সব মিলিয়ে যেটা থাকে, আবার সেটাকে ছাপিয়ে যায়।  "খন্ডন ভব"তে যাকে বলা হচ্ছে নির্গুণ গুণময়। একটা আহ্বান। সেটা কখনো মুষ্টিবদ্ধ হাত, কখনো গলার কাছে দমচাপা কষ্ট, আবার কখনো নিজেকে আইদেন্টিফাই করতে পারা। যেমন একদিন বৃষ্টিতে হয়ত দেখা হবে, উড়ে যাবে ছাতা, জুতো, মুছে যাবে সিঁদুরের টিপ। এই গানটার মধ্যে আমি একটা বন্য প্রেমের ইমেজারি পাই। কিংবা আরেকটা ঝড়ের দিন যেদিন সারা কোলকাতা কেনার নেশায় পাগল। কিনতে হবে বলেই কিনে ফেলল সোমনাথ খ্যাপা শহরের রাস্তাঘাট। আমার কাছে গড়িয়াহাটার মোড়, মেট্রো সিনেমারর সামনের ফুটপাথ সব মিলে মিশে যায়।  চোখ ধাঁধানো ঐশ্বর্যের পাশ কাটিয়ে, এগরোলএর গন্ধ মাখা নিভু নিভু আলোর ভারী গরীব একটা শহরের জলছবি উঠে আসে। সেই গোলপার্কের মৌচাক আছেনা, তার পাশের গলিটা। সেটাই আমার কোলকাতা।

তবে অঞ্জনের সেরা বিচ্ছুরণ বোধ হয় আত্মনিপীড়নের বা চিরন্তন হতাশার গল্পে। যেখানে স্যামসন একলা একলা মাঝরাতে ফিরে আসে চিলেকোঠার ঘরে, একলা বিছানায়, মদে ভিজে। ডেলায়লা কে কথাটা বলা হলনা কোনদিন। এটাও একভাবে আমার গল্প। নোনা দেওয়াল থেকে যীশু ছলছল চোখে হাত তুলে আশ্বাস দেয় এখনো। কিংবা সব পেয়েও নিজেকে অবিশ্বাস করে যাওয়ার যন্ত্রণা? নিজের গানের সব কথা, লাগবে আবার ছাপোষা। এ কথা যখন বলছেন, তখন অঞ্জনের বেলা বোস বেরিয়ে গিয়েছে। শহুরে মধ্যবিত্ত জানে রাস্তার ধারে শস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী থাকার যে অনুভব, তার ব্যালাড গাওয়ার লোকটি চলে এসেছেন এ কোলকাতায়। তবু ভয়াবহ অপ্রাপ্তি তাড়া করে বেড়ায় অঞ্জনকে, যেটা সত্যিই হওয়া উচিত যে কোনো শিল্পীর। কিন্তু কতজন সে কথা মেনে নেন? নিজের লিমিটেশন স্বীকার করার কুন্ঠাহীন এই উচ্চারণ আমার ভীষণ কাছের। প্রিয় বন্ধুর কথা আর বললামনা। যাকগে, কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে।

সুতরাং, সব শেষে, অঞ্জন খুব বেশি পার্সোনাল। সুমন চন্দ্রবিন্দু আমি লোকজন কে ডেকে শুনিয়েছি। অঞ্জন খুব ঘোরতর ভাবে একান্ত। যার ভালো লাগবে, লাগবে। বেশির ভাগ লোকেরই লাগবেনা। যাদের লাগবে, তাদের কখনো কখনো একটি দুখী মানুষকে মনে পড়বে, যে গিটার নিয়ে একা একা গান গায় নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে তে, রাত্রি শেষে অন্ধকার এফ ট্রেন ধরে জামাইকায় ফেরে চুপচাপ। সুনীল গাঙ্গুলী বলে গেছিলেন, ভ্রু পল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে। আমার মনে হয় খুব কমজনই অঞ্জনকে সেই ডাকটা দিতে চায়। আমি সেই ডাকটা দিয়েছিলাম। সুতরাং, এ চন্দনের বন, এ কোলকাতা ষোলো, আমার। একমাত্র আমারই। 

Saturday, March 14, 2015

Narendrapur: 2

নরেন্দ্রপুর এর যে কোনো গল্পে অবধারিত ভাবে থাকবেন অজিতদা, মানে অজিত সেনগুপ্ত। দীর্ঘকায়, কৃশ, প্রায় ভয়াবহ দর্শন এই মানুষটি সারা জীবনে যে পরিমাণ শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছেন, ভগবান ও ঈর্ষান্বিত হবেন। অবশ্য মিশনের ছেলেপুলে এমনিতেও ভগবানকে একটু কম সম্মান দিয়ে থাকে। বিরিয়ানি খুবই ভালো খেতে, কিন্তু রোজ সকাল বিকেল খেলে আরসালানেও অরূচি হতে বাধ্য।
অজিতদা পড়াতেন জীবন বিজ্ঞান। আমরা বলতুম বায়োলজি, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ বলত লাইফ সায়েন্স, অজিতদা বলতেন সায়েন্স অফ লাইফ। ফিরে দেখলে মনে হয়, একটু বেশীই মোহগ্রস্ত ছিলাম। আঠারো বছর বয়েস মাথা তোলবার, স্পর্ধা দেখানোর, চোদ্দ অনুসরণের, ব্যক্তিপূজার। শিক্ষক দিবস, আমরা তখন ক্লাস টেন। স্কুলের মেন বিল্ডিং এর সামনের রাস্তায় লাইন করে দাঁড়িয়ে ছেলেরা, মাঝখান দিয়ে নমস্কার এর ভঙ্গিতে হাত দুটো জড়ো করে হেঁটে আসছেন অজিতদা, যেমন অস্কারের রেড কার্পেটে হেঁটে যান ড্যানিয়েল ডে লুইস। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি, মাথা ইষৎ নত, মুখে একটা অদ্ভুত তৃপ্তির হাসি। আমার জীবনের দেখা সেরা দৃশ্য গুলোর মধ্যে একটা। তেরো বছর পরে, আজও চোখের সামনে ছবির মত ভাসে।
অজিতদার হিউমার ছিল শৈল্পিক। এস্পেশালি, পরীক্ষার খাতায়। প্রজাপতির জীবনচক্র আঁকতে গিয়ে একটি ছেলে প্রজাপতিটির উপরে একটু বেশীই পক্ষপাত দেখিয়ে ফেলেছিল। ছেলেটির আঁকার হাত ভালো, ওয়াল ম্যাগাজিনে নিয়মিত ছবি আঁকে, কাঁহাতক আর লার্ভার ছবি আঁকতে ভালো লাগে। খাতা বেরোলে দেখা গেল, অজিতদা সে প্রজাপতির তলায় ভারী সুন্দর অক্ষরে লিখে দিয়েছেন, "শুভ বিবাহ"। আমাদের অনেকেরই ধারণা ছিল, লাইফ সাইন্সে যেকোনো প্রশ্নে ছবি এঁকে দিতে পারলে ভালো নাম্বার পাওয়া যাবে। হৃতপিন্ড রিলেটেড কোন এক প্রশ্নে কেউ একটা ভারী সুন্দর ছবি এঁকেছিল, সময়ের অভাবে নিলয় বা অলিন্দটা পয়েন্ট
করে আসতে পারেনি। খাতায় লেখা ছিল, এ হৃদয় কোত্থেকে এলো, কেনই বা এলো, কার জন্যেই বা এলো।
ছোটবেলা থেকেই ইঁচড়ে পাকা ছিলাম, সুত রাং প্রশ্ন করার অভ্যাস ছিলই। কিন্তু সে প্রশ্নকে অজিতদার মত প্রশ্রয় দেওয়ার লোক বেশী ছিলনা। আমরা যখন বয়ঃসন্ধিতে, তখনও মধ্যশিক্ষা পর্ষদের জীবনশৈলী শিক্ষা শুরু হয়নি। কিন্তু প্রতিভা ও ছোটভাই কে চেপে রাখা যায়না, সময় হলে তারা ফুঁড়ে বেরোবেই। সুতরাং, আমাদের মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি, এবং মেয়েদের অভাবে কিছু কলি পথভ্রষ্ট হয়ে ভুল পথে যাচ্ছে, মহারাজদের উপরেই দ্বায়িত্ব পড়ল সে সব সামলানোর। উদ্দেশ্য মহৎ সন্দেহ নেই, একসিকিউশনে কিছু প্রবলেম দেখা যেত। একজন মহারাজ ছিলেন খুবই স্ট্রেট ফরওয়ার্ড, শোনা যায় ছেলেদের ডেকে জিজ্ঞেস করতেন, "এই ছেলে তোমার হয়"? একটি ছেলে ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বলেছিল, হ্যান হয় তো। মহারাজের ছেলেটির হাবভাব দেখে সন্দেহ হয়, অতঃপর, "কি রঙের বলতো"? ছেলেটির ছোট্ট উত্তর আজও ইতিহাস: "বেগুনি"। এই মহান প্রচেষ্টা যে খুব বেশী কার্যকরী হয়নি, বলাই বাহুল্য।
এই ছোট্ট ডিটুরের কারণ একটু পরেই পরিষ্কার হবে। মিশনের জীবনশৈলী শিক্ষার মূল বক্তব্য ছিল ব্রহ্মচর্য। এমনি এমনি এ কথা বাজারে আসেনি যে নরেন্দ্রপুরের খাদ্য আলুময়, জীবন ঘন্টাময় ও চিন্তা ব্রহ্মময় । অবশ্য দুর্জনে বলেই থাকে চরিত্র হল সাহস ও সুযোগের অভাব। যাকগে, যে কথা হচ্ছিল। মূল বক্তব্য ছিল, মনকে পরিষ্কার রাখতে হবে, এবং রেতঃক্ষরণ মহাপাপ। মহারাজদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, আঠারো বছর অধঃপতন না হলে ইয়ে উর্ধ্বগামী হয়ে কূলকুন্ডলিনীতে সুড়সুড়ি দেয় এবং সেই চাপে মানুষ ব্যাটম্যান হয়ে যায়, একথা স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব বলে গেছেন। বিশ্বাস না হয় কথামৃত খুলে দেখতে পারেন। কিন্তু কিছু ব্যথা থাকেই, তীব্র জাতের, কিছু কিছু ব্যথা থাকেই, মধ্যরাতের। সুতরাং অজিতদাকে জিজ্ঞেস করা হলো। মৃদু হেসে অজিতদা বললেন, ওটাকে যারা বীর্য নাম দিয়েছে, তাদের উপর আমার করুণা হয়। শোন, জন্মিলে মরিতে হবে, এটা মানুষের জন্য যেমন সত্য, স্পার্মের জন্যেও। তুই না মারলে, নিজেই মরবে। সুতরাং, ক্লৈব্যম মা স্ম গমঃ পার্থ। ওই ভীষণ অপাপবিদ্ধ পরিবেশ, যেখানে কান পাতলে বাঁশ ঝাড়ে ঝাড়ে ওম ওম ধ্বনি শোনা যায়, সেখানে দাঁড়িয়ে এই কথা বলতে সাহস লাগে স্যার।
আগেই বলেছি স্টাডি হলগুলো ছিল যত অপকর্মের জায়গা। তখন আমরা ক্লাস টেনে, লাইফ সাইন্সে ব্যাং ইত্যাদির জনন পড়ছি, এবং পড়াচ্ছেন অজিতদা। সন্দেহ নেই খুব জোরদার পড়া হচ্ছে। এখন ভাবলে ভয়াবহ অবাক লাগে, একদিন সন্ধেবেলা আমি একটা মশাকে ধরে আতস কাঁচ দিয়ে তার গোপনাঙ্গ খুঁজেছিলাম। পাওয়া যায়নি। পরের দিন ক্লাসের শেষ, অজিতদা হন হন করে বেরোচ্ছেন, আমি হাত তুললাম, স্যার, মশা কি যৌন জনন করে? থেমে গিয়ে অজিতদা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন, কেন? না অজিতদা কালকে সারা সন্ধে ধরে খুঁজেও ওটা দেখতে পেলাম না। দু মিনিট দাঁড়িয়ে ধুতিটা হাঁটুর কাছে তুলে আনলেন, তারপর সেই প্রশ্রয়মিশ্রিত দাঁতখিঁচুনি, আমারটা দেখতে পাচ্ছিস? সন্দেহ আছে, আমি যৌন জনন করি?
অজিতদা মারা গেছেন, তাও আজ চার বছর হয়ে গেল। কঠিন হাঁপানির রোগ ছিল, জেনেটিক। সেই বিষ আর পরের প্রজন্মে যেতে দেবেন না বলে বিয়ে করেননি, এক পালিতা কন্যা ছিলেন, বাপ বেটিতে থাকতেন নরেন্দ্রপুরের সামনেই। স্কুল ছেড়ে আসার পরে দু একবার দেখা হয়েছে, যতবারই প্রণাম করেছি, বলেছেন, শোন পারলে পড়াস। আমাদের ওয়েল্টন একাডেমির কৌলিন্য ছিলোনা, পাশের স্কুলে বুকে কাঁপন ধরানো শমিতা শেট্টি ছিলনা, কিন্তু নিয়ম ভাঙ্গার স্পর্ধা ছিল, আর তাতে প্রশ্রয় দেওয়ার অজিতদা ছিলেন। তিনিই ছিলেন আমাদের ডেড পোয়েট সোসাইটির রবিন উইলিয়ামস, মহব্বতের শাহরুখ খান। মৃত্যুর পরে কিছু থাকেনা জানি, তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, ফর্সা ধুতি পাঞ্জাবির দীর্ঘকায়, দাঁত উঁচু সেই
মানুষটি দূর থেকে লক্ষ্য রাখছেন, জীবনের বিজ্ঞান কতটা বুঝলাম। ভালো থাকবেন, অজিতদা। ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন।

Narendrapur: 1

নরেন্দ্রপুর নিয়ে দুকলম লিখে যাই। প্রথম নাম মনে আসছে নাড়ুর। নারায়ণ
মহারাজ, যোগানন্দ ভবনে থাকতেন। বিপাশা বসুর হাস্কিনেসের  সাথে অমিতাভ
বচ্চনের গাম্ভীর্য মেলালে অমন গলা হয়। গরমকালে ফ্যান চালালে কেন ঘাম
শুকিয়ে যায়? ফিজিক্সের একটা কমন ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু নাড়ুর একটা
বায়োলজিকাল বক্তব্য ছিল। পাখার হাওয়া ত্বকের উপর প্রেশার দিয়ে ঘামটা
ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। আরো কিছু মণি মুক্তো ছিল, পরে বলা যাবে।

আর একজন ছিলেন সুনীতিদা, বাংলা পড়াতেন। আজ অবধি অমন ভালো হাতের লেখা
দেখিনি। তেমনি মারতেন। স্টাডি হল বলে একটা জায়গা ছিল প্রত্যেকটা
হোস্টেলে, সেখানে দল বেঁধে পড়াশুনো করার কথা সকাল ৬টা থেকে ৮টা অব্দি,
কিন্তু সবাই ঘুমোতো। ন্যাচারাল ব্যাপার। সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠলে
মানুষ সন্ন্যাসী বা পারভার্ট হয়ে যায়।  এই স্টাডি হল গুলোতে একজন স্যার
আসতেন, যাঁদের কাজ ছিল প্রাইমারিলি  ছেলেপুলে কে ঘুম থেকে তোলা। বেশীর
ভাগ স্যারই দাঁড় করিয়ে দিতেন, এবং বছর তিনেকের মধ্যে দেখলুম সকলেই
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমনোর ব্যাপারটা বেশ অভ্যাস করে ফেলেছে। সেই থেকে আমি
ডারউইন এর তত্বে বিশ্বাসী হয়ে উঠি, এবং প্রেয়ার হলে ঘুমোনো অভ্যাস করে
ফেলি। সুনীতিদা শুধু দাঁড় করানোয় বিশ্বাস রাখতেন না। ডেস্কে মাথা রেখে
শান্তিতে ঘুমোচ্ছে, এমন জোয়ান মদ্দ ছেলেকে, বললে বিশ্বাস করবেন না, জুলপি
ধরে, জাস্ট জুলপি ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে  দিতেন। তারপরে পড়াশুনো হোক বা না
হোক, যন্ত্রণার চোটে ঘুমোনো আর সম্ভব হতোনা।

এই সুনীতিদা "স" বর্ণটা অদ্ভুত ভাবে উচ্চারণ করতেন। ব্যাপারটা ছিল অনেকটা
স,জ আর ঝ এর মিশ্রণ। আমরা আড়ালে বলতুম জঝ্যানীতি। খুবই গম্ভীর প্রকৃতির
লোক, চুপচাপ থাকেন। একদিন স্টাডি হল বেশ শান্ত, সুনীতিদার পাশের ডেস্কে
বসে একটি ছেলে উদাস হয়ে সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাত দেখে
দেওয়াল বেয়ে একটা টিকটিকি উঠছে। ছেলেটি চটি খুলে মোক্ষম টিপ করতে যাবে,
সুনীতিদা চেয়ার থেকে প্রায় ধুমকেতুর স্পীডে লাফিয়ে উঠলেন, "খবরদার,
স্ট্যাকটিকির গায়ে কেউ হাআআত দেবেনা"। এই অলৌকিক ঘটনার আজ অব্দি কোনো
কারণই খুঁজে পাইনি।

আলাভোলা টিকটিকি প্রেমী স্যারেরা ছিলেন, ভালো মন্দ বিজ্ঞানী অজ্ঞানী
গেরুয়া সাদা মহারাজেরা ছিলেন,  সন্ধের ঘুম জড়িয়ে আসা চোখে শাঁখের আওয়াজ
ছিল, পাশের মোল্লাপাড়া থেকে ভেসে আসা অপার্থিব চিত্কার ছিল, অদ্ভুত নিয়ম
ছিল, সেই নিয়ম ভাঙ্গার আনন্দ ছিল, সব মিলিয়ে নরেন্দ্রপুর বড় মায়াময় ছিল।
পিছন ফিরে দেখলে রূপকথা মনে হয়।