Sunday, November 21, 2021

বাংলা সিনেমা

 কিছুদিন ধরে একটা প্রতিজ্ঞা নিয়ে বসে আছি যে সিনেমা দেখলে বাংলা সিনেমাই দেখবো, নয়তো ডকুমেন্টারি। এর ফলে বেশ কয়েকটা বাংলা সিনেমা দেখা হলো, এবং মা কি হইয়াছেন ধরণের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কদিন বসে রইলাম। কোলকাতায় হলে গিয়ে কেদারনাথ এর দশটি শো অগ্রাহ্য করে দেখেছিলাম জেনারেশন আমি, তার পরে বহুক্ষণ ভেবেও বুঝতে পারিনি এ কার জেনারেশন, আমার তো নয়ই, অথচ আমার হওয়ার ও কথা ছিল, আমিও তথাকথিত মিলেনিয়াল। খুব দুঃখে কাটালাম কয়দিন। তাহলে কি সত্যিই বুড়ো হয়ে গেলাম? তবে যে পড়েছিলাম আসলে কেউ বড়ো হয়না বড়োর মতন দেখায়? মামণি কে বললাম নেটফ্লিক্স দিতে। 

নেটফ্লিক্সে প্রথম দেখলাম মেঘনাদবধ রহস্য। ভালো হয়েছে বলে আশা করছি, মানে পুরোটা দেখতে পারলে ঠিকঠাক বুঝতে পারতাম, কিন্তু সব কটা ক্যারেক্টার শুরুর থেকে এমন ঘ্যানর ঘ্যানর করে মাথা ধরিয়ে দিলে যে মিনিট চল্লিশের মধ্যে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ভরসা আছে প্রতিদিন তিরিশ মিনিট করে দেখে শিগগিরই ব্যাপারটা শেষ করে ফেলতে পারবো, যদিও এতো ঘটনার ঘনঘটা যে প্রতিদিন দশ মিনিট রাখতে হচ্ছে রিভিশন এর জন্যে। আকবর এর দাক্ষিণাত্য নীতি এর থেকে মনে রাখা সহজ ছিল, এবং ফ্র্যাঙ্কলি আরো ইন্টারেস্টিং ও।   

তারপরে দেখলাম শব্দ। অনেকেই বলেছিলেন সিনেমাটা শুধু ঋত্ত্বিক চক্রবর্তীর জন্যেই দেখা যায়। যেটা বুঝিনি সেটা হচ্ছে এটা একটা ইফ এন্ড এলস কন্ডিশন। সিনেমাটা ঋত্ত্বিক এর জন্যে দেখা যায়, এবং বাকি সব কারণেই শুধু পরিহার্য নয়, পরিহার করাটাই কর্তব্য। সিরাজের মখমলি চিকেন রোল হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে শুরু করে সিনেমাটা যে সেকেন্ড হাফে অনিবার্য ডিম্ পরোটায় পরিণত হলো, তার জন্যে ঠিক কাকে দোষ দেব শিওর নই। খুব উপরের দিকেই থাকবে চূর্ণী গাঙ্গুলীর ঠোঁটচাপা উচ্চারণে অযুত জ্ঞানের হ্যাজ এবং সৃজিত মুখার্জির প্রায় গোটা সময় ধরে মরা গোরুর মতো নিশ্চল চোখে চেয়ে থাকা। ছোটবেলায় ইস্কুলে চুল অবিন্যস্ত থাকলে মুকুন্দ দা বলতেন কি ভেবেছিস চুল না আঁচড়ালেই আইনস্টাইন হবি? আমার ধারণা সৃজিত বাবু কোনো অভিনয়ই না করে রনবীর শোরের মতন আন্ডার এক্টিং করতে চেয়েছিলেন। ওনার দোষ নেই, ছোটবেলায় উনি তো মুকুন্দদা কে দেখেন নি। গোটা সিনেমা ধরে ভিক্টর ব্যানার্জী বলে গেলেন আই এম দ্য বেস্ট, কেন যে তার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। সলিউশন তো সেই ঘ্যানঘেনে চূর্ণীই দিলেন। সত্যি বলতে কি এই শেষ ব্যাপারটায় আমি এতোটাই ট্যান খেয়েছি যে বিশ্ব সিনেমার প্রতি আমার অজ্ঞতার উপরে না বোঝাটা ছেড়ে দিলাম। হতেও পারে উনি কিয়ারোস্তামির ভূত, যিনি পরবর্তী সিনেমায় অঞ্জন দত্তের কাঁধে চাপবেন। 

(কৌশিক গাঙ্গুলীর দুটি সিনেমা আমার অসম্ভব প্রিয়, সিনেমাওয়ালা এবং ছোটদের ছবি। বিসর্জন, বিজয়া দেখিনি, কিন্তু শুধু অভিনেতা কৌশিক গাঙ্গুলীকে দেখার জন্যেই আমি এই সিনেমাগুলি দেখতে ইচ্ছুক)

এরপর দেখলাম ট্রেলার। শাহজাহান রিজেন্সির। দুটো কথাই বলার আছে। প্রথমতঃ গানটি আমার অসম্ভব প্রিয়। কিছুটা পার্সোনাল কারণেও, এবং সমস্ত মহান শিল্পই ডিপলি পার্সোনাল। খুব সংক্ষেপে বললে, প্রেমটা অনেকদূর গড়িয়ে গেলো এই গানটার জন্যেই। তখন অবশ্য সৃজিত মার্কেটে ছিলেন না। থাকলে কি হতো জানিনা। ভালো কিছু না আমি মোটামুটি নিশ্চিত। আর একটা ব্যাপার: এটা আগেও মনে হয়েছে যে সৃজিত এর সিনেমায় খুব স্পষ্ট, বোল্ড এন্ড আন্ডারলাইন প্যারালাল থাকে, যেমন ধরুন উমাতে উমার মা মেনকা বাবা হিমাদ্রী, এক যে ছিল রাজাতে "মহারাজ একি সাজে" গানের ব্যবহার। ভদ্রলোক সেই ধারা অক্ষুন্ন রেখেছেন দেখলাম। পতিতার মৃত্যু হলো পতনের ফলে। আহা ইস্কুলের সুনীতিদার বাণী মনে পড়ে যায়, অধঃপতনে শব্দ হয়না। 

এই পরিস্থিতিতে আজকে দেখলাম একটা সিনেমা এসেছে কমলা রকেট। বাংলাদেশী সিনেমা, সিনেমার ডিরেক্টর বাংলাদেশের আরেক বিখ্যাত পরিচালক মোহাম্মদ সারোয়ার ফারুকীর আগের একটি সিনেমার নায়ক। ফারুকীর সিনেমা আমি প্রথম দেখতে শুরু করি ওনার স্টেডি নায়িকার জন্যে, যাঁর নাম নুসরাত ইমরোজ তিশা, অসম্ভব মিষ্টি একটি মেয়ে। তিনি এখন ফারুকীর বৌ ও বটে। আফশোষ এর কথা। এনিওয়ে, আই ডাইগ্রেস। এ বঙ্গের রিসেন্ট বাংলা সিনেমা দেখে (আমি সহজ পাঠের গপ্পো দেখিনি, এবং বিলু রাক্ষস ও নয়, দুটো সম্পর্কেই উচ্ছস্বিত প্রশংসা যাকে বলে রেভ রিভিউ পেয়েছি ফেসবুকে) আমি ক্রমাগতঃই একটা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগতে থাকি। প্রথমতঃ ক্যামেরা ঘরের বাইরে খুব একটা বেরোয় না, এবং ঘরের মধ্যেও যাদের উপরে ফোকাস করে তাদেরকে আমি একেবারেই চিনতে পারিনা। ঋতুপর্ণ ঊনিশে এপ্রিল করে সেই যে সাউথ সিটি তে ক্যামেরা ঢুকিয়ে দিলেন (তখন মনে হয় এসব ছিলোনা, হাইরাইজ বলতে মেঘমল্লার, যাগ্গে), তারপরে তো আর সে বেরোলোই না, এবং কোলকাতার উচ্চমধ্যবিত্তের  সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো টলিউডের স্টেপল। অঞ্জন দত্ত মাঝখানে একটু হাঁউ মাঁউ করেছিলেন, বাংলা সিনেমায় সবাই ওয়াইন খায় কেউ বাজার যায়না কেন বলে। ঠিক তারপরেই বানালেন গণেশ টকিজ যেখানে বাড়ির ছাদে পৃথুলা নায়িকা কটাক্ষে কোমর দোলায় আমার ঝাল লেগেছে বলে। সুতরাং।

এইখানে চারটে বাংলাদেশী সিনেমা আমাকে অবাক করেছে। মনপুরা, টেলিভিশন, অজ্ঞাতনামা এবং কমলা রকেট। এই সিনেমাগুলি মধ্যবিত্তের চাউমিন খাবে না হাফ পেগ মদ ইত্যাদি ন্যাকা ক্রাইসিসের বাইরে বেরোয়। ক্যামেরা আদিগন্ত চরাচরে খেলা করে। নীল রঙে উঠে আসে হাওরের বিস্তার। এবং কি সৌভাগ্য গানগুলি স্ট্যান্ডার্ড ক্যালকেশিয়ান ইমেজারি এবং তৎসংলগ্ন ঘ্যানঘেনে সুর নিয়ে আঁকড়ে থাকেনা। আজকে আমি দেখেছি এদের মধ্যে শেষ সিনেমাটি। নেটফ্লিক্সে এভেলেবল। এই দীর্ঘ হ্যাজ তার ই ফলশ্রুতিতে। সিনেমাটি সম্পর্কে আমি এখনই কিছু লিখবোনা। কারণ সিরিয়াস কিছু লেখা এখন সম্ভব নয়। আর তা ছাড়া সিরিয়াস ফিল্ম রিভিউ করার যোগ্যতাও আমার নেই।  

শুধু একটাই কথা বলার। আফজার নাফিসি বলে একজন ইরানিয়ান স্কলার একটি বই লিখেছিলেন, রিডিং লোলিটা ইন তেহরান। বইটার শেষে নাফিসির একটা ইন্টারভিউ রয়েছে, যেখানে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, কেন মানুষ বই পড়ে? নাফিসি বলছেন দুটো কারণে: টু নো এন্ড টু ফিল এম্প্যাথি। যেকোনো শিল্প কীর্তি বিশেষতঃ ন্যারেটিভ মূলক, যেমন সিনেমা,  (সদ্য মৃণাল সেন মারা গেছেন তাই ফর্ম এর ব্যাপারে যারা গাঁতিয়েছে আমিও তাদেরই দলে, সুতরাং সিনেমা মানেই ন্যারেশন নয় এই এঙ্গেলে খেলবেন না) কেন ভালো লাগে তার জন্যে এর থেকে ফোকাসড উত্তর আমি পাইনি। 

বাংলাদেশের সিনেমা দেখে যে এম্প্যাথি আমি ফিল করতে পারছি, দুঃখজনক হলেও এ বাংলার সিনেমা আমাকে সেই অবগাহন বোধ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তবু আমি ছাড়ছিনা।   দেখে যাবো। একদিন নিশ্চয়ই দেখা হবে চন্দনের বনে।

স্টেট কলেজ, পুজো

খেতে বসে ঋতুপর্ণ ঘোষের একটা সিনেমা চালিয়েছিলাম। উৎসব। অনেকবার দেখা সিনেমা, তবুও ভাবলাম একটু দেখি। ঋতুপর্ণ অসামান্য স্টোরিটেলার, তাঁর সিনেমা দেখতে শুরু করলে থামা যায়না। দেখা শেষ হতে মনে হলো, আমাদের উৎসব তো চলে এলো। পৃথিবীর গভীর অসুখ এখন, এই সব হই হট্টগোল নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায় মানুষের। তবু বৃষ্টি থেমে মাঝে মাঝে বল্লমের ফলার মতো উঁকি দেয় শরতের রোদ্দুর, ঘন কংক্রিটের জঙ্গলে আচমকা শিউলির সুবাতাস বয় আর বাঙালীর মন কেমন করে ওঠে। মা আসছেন। ওই শোনো শূন্যপথে রথচক্র-ধ্বনি, ও নহে শারদ মেঘে লঘু গরজন; ছাড়িয়া অনন্তধাম সৌন্দর্য-কৈলাশ, আসিছেন এ বঙ্গের আনন্দ-রূপিনী।

আমার কাছে পুজো মানে স্টেট কলেজ। সেই যে একদিন রাত্তির এগারোটার সময় ছোট্ট একটা প্লেনে চড়ে একটা অন্ধকার ততোধিক ছোট এয়ারপোর্টে নামলাম, ভাবতেই পারিনি একদিন ছাড়ার সময়ে প্রাণটা একেবারে কেঁদে উঠবে। চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটা গ্রাম, সেগুলোকে পাহাড় বললে ভুল হবে, টিলা গোছের। কিন্তু একেবারে ন্যাড়া নয়, এলোমেলো সবুজ ও খয়েরি, প্রথম যৌবনের মতো উদ্দাম। সেখানে আকাশ কী ভীষণ তীব্র নীল আর চারিদিক চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো সবুজ। মধ্যে মধ্যে নিকোনো রাস্তাঘাট আর তার দুইপাশে একতলা দোতলা বাড়ি ও বাগান, তাতে অপ্সরাবিভঙ্গী লতা ও ফুলের কেয়ারী। মোট কথা প্রথম দর্শনেই ঝট করে প্রেমে পড়ে গেলাম। 

অগস্ট মাসের শেষে একটা গেট টুগেদার হলো, সেখানে লোকজনের সাথে প্রথম আলাপ, আর পুজোর দিন টিন ঠিক করা হলো। দেখলাম একজন নাম ধাম লিখে নিলো কে কি করতে পারে, আমি ছোটবেলায় পেপার কেটে নকশা বানাতাম, খুব উৎসাহের সাথে নাম দিয়ে দিলাম। তারপরে আর কথাবার্তা নেই, ভাবলাম ভালোই হলো, আমি খুব একটা সদালাপী মানুষ নই, পুজোয় না হয় একাই একটু রান্নাবান্না করে খেয়ে নেব। সেইমতো কাছের একটা শহর থেকে গিয়ে বরফ জমা ইলিশ মাছও নিয়ে এলাম। পুজোর আগের দিন সন্ধেবেলায় কিন্তু ফোন এলো, আর তারপরে কে একটা গাড়ি করে একটা ইস্কুল বিল্ডিং এর মধ্যে ঢুকিয়ে কেটে পড়লে। সেখানে ঢুকে দেখি একটা হলঘরের মধ্যে ভয়ানক দক্ষযজ্ঞ চলছে। কেউ মন দিয়ে ছবি আঁকছে, কেউ ঝাঁটা হাতে ঘর পরিষ্কার করছে, ঘরের মাঝখানে একদঙ্গল ছেলেপুলে মিলে বোধহয় নাটকের রিহার্সাল দিচ্ছে কিন্তু সেদিকে আমাকে কেউ ঘেঁষতেই দিলেনা কারণ তাতে এক্সক্লুসিভিটি নষ্ট হয়ে যাবে। বিমর্ষ হয়ে বসে অপমানের পরিমাপ করছি, ডেকোরেশনের দ্বায়িত্ত্বে যে ছেলেটি ছিল সে বললে আরে তুই পেপার কাটিং করবি না? চল কি লাগবে কিনে নিয়ে আসি। আবার গাড়ি চড়ে চল্লুম, সঙ্গে আরেকজন দাদা, তাঁর আসার উদ্দেশ্য প্রথমে বুঝিনি, একটু পরেই পরিষ্কার হলো। এ দোকান ও দোকান ঘুরে যাই কিনতে যাই, দাদাটি মুখ গোমড়া করে মাথা নাড়েন, বাজেটে কুলোবেনা। উনি ফাইনান্স মিনিস্ট্রিতে ছিলেন আর কি। যাই হোক যা কিছু একটা কিনে ঢুকতেই দেখলাম ঘরের এক দেয়াল জুড়ে অধিষ্ঠান করে আছেন সে কি ভীষণ মিষ্টি একটি একচালার ঠাকুর, তাঁর হাইট তিনফুট হলে কি হবে, অলঙ্কারের খামতি নেই, এমনকি গণেশের ইঁদুরের ল্যাজটুকু পর্যন্ত বড়ো যত্ন করে গড়া। এই ঠাকুর কালকে বিসর্জন হয়ে যাবে ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে গেছিলো, কিন্তু একজন খুবই আশ্বাস দিয়ে জানালেন এখানে বিসর্জন হয়না, ফি-বচ্ছর একই মাতৃপ্রতিমা, পুজো শেষে আবার এনাকে যত্ন করে তুলে রেখে দেওয়া হবে। তারপরে ভীষণ হুলুস্থুলু করে কাগজ তো কাটলামই, একেবারে সব্বাই মিলে সকল কাজের কাজী হয়ে বসলাম। মাঝখানে কখন পিৎজা এলো, তার খরচ খরচা নিয়ে সিনিয়ার লোকজন একটু ভ্রূকুঞ্চন দেখিয়েও আবার পটাপট নিজেরাই হৈ হুল্লোড় করে তিন চারটে করে পিস্ খেয়ে ফেললেন আর আমিও সক্কলের সাথে মিলে গেলাম খেয়ালই হলোনা। রাত তিনটের সময় দেখা গেলো ব্যাপারটা একটু দাঁড়িয়েছে, একটা ছোট্ট বেদীর উপরে পুত্র কন্যা সহ দাঁড়িয়ে মা স্বয়ং আর তাঁর জ্যোতির্বলয় জুড়ে পটু ও অপটু হাতের কিছু কারুকীর্তি এবং অনেকগুলি উদ্বেল নবীন হৃদয়। নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে দিতাম কিন্তু একজন এসে তাড়া লাগলেন, তাঁকে পরের দিন সকালে এসে আবার ঘরের দরজা খুলতে হবে, পুজোর আয়োজন শুরু হবে সকাল সাতটা থেকে। তাঁর তীব্র সময়ানুবর্তিতাকে মনে মনে বহু ধিক্কার জানিয়ে সেদিনের মতো ঘরে ফিরলাম।   

পরের দিন সকালে আর উঠতে পারিনি, ভাবলাম এতে কি আর পাপ হবে, কালকে রাত্রে তো যাকে বলে জমিয়ে মায়ের পদসেবা করেই এসেছি। সন্ধে বেলায় একবারে ম্লেচ্ছ ড্রেসে হাজির হয়েছি, কিন্তু ঢুকেই বুঝলাম বড়ো ভুল হয়ে গেছে। গত কালকের যে ব্যস্ত ছেলেটি থ্রি কোয়ার্টার পরে হাতুড়ি নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছিল ঘরময়, আজ তার পরণে বাহারী শেরওয়ানি ও যত্নে বিন্যস্ত চুল, আর বাঙালী মেয়েরা চিরকালই শাড়িতে অপরূপা, আজ তাঁদের চেনাই মুশকিল। মাড় ভাঙ্গা শাড়ির খসখসানি ও অনভ্যস্ত পাঞ্জাবীর ফাঁক দিয়ে কিছু অপাঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় দেখে মনটা একটু খারাপ হলো, ইস্কুলে থাকতে এই একটি মাত্র অভ্যাসই হয়েছিল, তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে বেশ গুছিয়ে ধুতি পরতে পারতাম, সে বিদ্যে একেবারে মাঠে মারা গেলো। তারপরে কালচারাল অনুষ্ঠান শুরু হলো, সে বেশ জমাটি  ব্যাপার, তাতে নাচ গান কবিতা আবৃত্তি সবই হলো। শেষ পাতে এলো একটি অনবদ্য নাটক, অনেকদিন পরে এমন প্রাণ খুলে হাসলাম। শেষে খাওয়া দাওয়া গল্প স্বল্প এমনকি রাত্রে মায়ের প্রসাদও পাওয়া গেলো কিছু। এক দিনেরই উৎসব, কিন্তু তাতে আজীবনের প্রাণ ঢালা। এই হলো প্রবাসের পুজোর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। 

তার পর তো স্টেট কলেজে কত দিন কাটলো, কত অসম্ভব গল্পের জন্ম হলো, অযুত সম্ভাবনার মৃত্যুও দেখলাম, কিন্ত এই বচ্ছরকার দিনে সক্কলে মিলে যে আনন্দের উৎসব, তার কখনো ব্যত্যয় হয়নি। টাকা পয়সার টানাটানি হয়েছে, কেউ নিজের ভান্ডার উপুড় করে দিয়েছেন। বড়ো লেখকের লেখা নাটক করলে সব্বাই পার্ট পাবেনা, আমরা নিজেরাই লিখেছি নাটক। উচ্চাঙ্গের কিছু হয়নি, কিন্তু তার এক্সপেক্টেশনও ছিলোনা, পরিণতি তো লক্ষ্য নয়, জার্নিটাই আসল। নিজেরাই দল  বেঁধে বাজার করেছি, নিজেরাই রান্না। নিজেরাই নিজেদের পিঠ চাপড়েছি, গালি দিয়েছি, মান অভিমান করেছি, ভালোও বেসেছি। সব চেয়ে বড়ো কথা অজস্র বাধা বিপত্তিতেও কিছুই থামেনি, স্টেট কলেজ ছেড়েছি চার বছর, কিন্তু যতবার পুজোর আগের রাতে ফিরে গেছি সেই প্রথম দিনটির মতোই দেখেছি ঘর আলো করে দাঁড়িয়ে আছেন মা, আর তাঁকে ঘিরে অর্বাচীন উচ্ছল কিছু জীবন, যাদের ভালোবাসায় স্বর্গের দেবীকেও মাটিতে নেমে আসতে হয়। আমি যাঁদের প্রথম দিন দেখেছিলাম, তাঁরা নেই, আমিও নেই, কিন্তু পুজোটা আছে, ভালোবাসাটা আছে, গান গল্প স্বপ্ন গুলো আছে। আর কেউ যে নেই তাই বা কে বলতে পারে? নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে  নতুন বাহুর ডোরে, আসব যাব চিরদিনের সেই-আমি। 

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন আমরা অনেক সময় উৎসব করে ফতুর হয়ে যাই। নিঃস্বার্থ দান ছাড়া কোন উৎসবই বা সফল হয়? তিনি অসামান্য মানুষ, অনেক দানে তাঁর অধিকার। আমার দেওয়ার আছে স্বল্প, তাই প্রার্থনাও অতি সাধারণ। এ হতাশাজীর্ণ পৃথিবীর বুকে মা নেমে আসুন, শস্য শ্যামলা হোক মাটি। পাহাড় ঘেরা সেই ছোট্ট শহরটিতে সকলে সুখে শান্তিতে স্বাস্থ্যে থাক, আগমনীর আবাহনে প্রাণের কলরোলে ভরে উঠুক সেখানকার আকাশ বাতাস। মধুমৎ পার্থিবং রজঃ মধু দ্যৌরস্তু নঃ পিতা। সকলকে আগাম শারদ শুভেচ্ছা।

সংহিতা দি, রিমেমব্রেন্স, ১

 সংহিতাদি চলে গেলো। এই লাইনটা লিখে নিজেই আরেকবার চেয়ে দেখি। ঠিক দেখছি তো? কালকে দুপুরে তখন দুটো পঞ্চাশ, বাইরে ফেটে পড়ছে রোদ্দুর, পায়রা পিছলে যাবে এমন আকাশ। ফোনের ওপ্রান্তে পার্থদার কান্না শুনছি অঝোরে, নার্স বললো, আমরা দশ সেকন্ড দেবো, না রেস্পন্ড করলে, উই আর সরি। খুব ধীরে ধীরে সেই দশটি মুহূর্ত শেষ হলো, আমি ফোন রাখলাম। বাইরে তখন আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক, বসন্তের রং পেরিয়ে সবুজে ঢেকে যাচ্ছে সংসার। স্টেট কলেজে থাকলে সংহিতাদি ফোন করে বলতো, চল এতো ভালো ওয়েদার, একটু ঘুরে আসি আর আমরা কাজ টাজ ফেলে বেরিয়ে পড়তাম হঠাৎ। সেই নিরুদ্দেশে সংহিতাদি একাই চলে গেলো। পড়ে রইলো এ মায়াময় রাজপাট আর সাজানো ঘর গেরস্থালি। আমরা রয়ে গেলাম স্মৃতি কুড়োনোর মহা দায়িত্ত্ব নিয়ে।

"বিষণ্ণতা ছিল আমি মাথায় চড়তে দিইনি তাকে

অবসাদ দুশ্চিন্তারা রক্তমাখা আমাকে খুঁজেছে প্রতিদিন

অযথা ঘুমোতে আর অযথাই জেগে থাকতে কাঁহাতক ভালো লাগে আর?

আমার মাথাটা ছিল সবুজ ম্যাজিক

চলেছি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মনখারাপ মুছে দিতে দিতে।"

সংহিতাদির মৃত্যু নিয়ে আর কোনো কথাই বলবো না, যারা শেষ সপ্তাহটা দেখেনি, তাদের সে যন্ত্রণায় নিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয়না। আর যে মানুষটি সারাজীবন জীবনকেই সেলিব্রেট করেছে পাগলের মতন, তার শোকসভায় কেনই বা গম্ভীর বেদমন্ত্র উচ্চারণ হবে মৃদু সুরে? বরং সংহিতাদির কথা বললে আমরা বলবো পেনউডের সেই ম্যাজিকাল বাড়িটার কথা, যার দেওয়াল কিংবা দরজা জানলা কোনোটাই ছিলোনা, যখন খুশি ঢুকে পড়ে ইচ্ছে মতন আবদার করা যেতো। আজকে রাতের খাবারটা ভালো হয়নি, চল সংহিতাদির বাড়ি যাই। আজকে ল্যাবে দিন কেটেছে খুব বিরক্তিতে, চল সংহিতাদির বাড়ি যাই। রাত তিনটের সময় মদ খেয়ে বেরিয়েছি, খাবার দাবারের সন্ধান কোথায়? পেনউডে চল, ফ্রীজে কিছু আছে নিশ্চই। পার্থদা যখন এরিজোনায় চাকরি পেলো, প্রজেক্টর ভাড়া করে এনে দশ জন ছেলে মেয়ে মিলে আমরাই ওদের বাড়ি খুঁজলাম, কারণ আমরাইতো সেখানে থাকবো। সংহিতাদির বাড়ি তো আমাদেরই বাড়ি, সে বাড়ির উপরে যেন পার্থদারও দাবী অনেক কম। পার্থদা সে বাড়ির ভাড়া দেয়, একটু গম্ভীর মুখে পলিটিকাল আলোচনায় হয়তো যোগ দেয়, কিন্তু আমাদের সব হাসি ঠাট্টা আদর অভিমান সবার কেন্দ্রস্থলে তো বছর চল্লিশের সেই কিশোরী যে রাত তিনটের সময় মাতাল লোকজনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে চাঁদ দেখতে, কিংবা দরজা বন্ধ থাকলে জানলা বেয়ে উঠে যাবে তরতরিয়ে। সেই সব ঐন্দ্রজালিক বাড়িগুলো ছিল সংহিতাদির। আজ থেকে কি সেগুলো পার্থদার হয়ে যাবে? এ গুরুভার পার্থদা বইবে কেমন করে?

জীবনকে যারা গভীর ভাবে ভালোবাসে সংহিতাদির মতন, তাদের জন্যে সময় বড়ো কম থাকে মনে হয়। কিন্তু সেই সময়টুকুকেও সংহিতাদি নিংড়ে নিয়েছিল। যেমন ভালোবেসেছে মানুষকে, তেমন কি অসম্ভব যে ভালোবাসা পেয়েছে প্রতিটি মানুষের কাছ থেকে! এরিজোনা থেকে এক নার্স এই কোভিডের সময়ে আসছিলেন একবার দেখবেন বলে। গানে, আড্ডায়, বেড়ানোয় স্টেট কলেজের দিন কেটেছে বর্ণময়, কিন্ত অবাক হয়ে দেখলাম ২০১৬ তে যখন ওরা স্টেট কলেজ ছাড়লো, তার পরেও যারা এলো, একই রকম ভালোবাসার টানে পড়ে গেলো। ঈশ্বরেরও ঈর্ষা হয়েছে হয়তো, তাই কি এতো তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া? যখন ক্যান্সার ধরা পড়লো, প্রথমবার দেখতে গেলাম, খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম, কেমন দেখবো। দেখলাম সেই আগের মতনই মিষ্টি হাসি, সেই শাণিত রসবোধ। শেষের দিকে অসম্ভব যন্ত্রনাতেও কখনো বলেনি কষ্ট হচ্ছে, সারাজীবন রবীন্দ্রনাথের উপরে গভীর বিশ্বাসে প্রোথিত ছিল, আঘাত সে যে পরশ তব, সেই তো পুরস্কার। যদি একটি শিক্ষা সংহিতাদির জীবন থেকে পেয়ে থাকি, তা হলো এই নিঃশেষ পসিটিভিটি, জীবনকে উপভোগ করার এই দুর্দম আকাঙ্ক্ষা, কারণ এই অতল ভালোবাসার তল পাওয়া তো সম্ভব নয়; শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে? 

আমরা যারা স্টেট কলেজে ছিলাম, সংহিতাদির সঙ্গে ছিলাম, তাদের একটা উত্তরাধিকার রয়ে গেছে। দরজা বিহীন, দেওয়াল বিহীন সেই বাড়িটার উত্তরাধিকার। অনুপম বলতো আমি ম্যানহাটানে চব্বিশ তলার উপরে একটা বাড়ি কিনবো, সংহিতাদি বলতো কিনিস, তাহলে আমি সেখানে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে রাতের নিউ ইয়র্ক দেখতে দেখতে মুড়ি চানাচুর খাবো। সেইটা আর হয়ে উঠলোনা। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের বাড়ি তো একেকটা একান্নবর্তী পরিবার হয়ে উঠতেই পারে, যেখানে মানুষ জন ইচ্ছে মতো আসবে যাবে, খাবে, গল্প, গান করবে, প্রেম অপ্রেম, ভালোবাসার অনেক অনেক কাহিনী তৈরী হবে। কালকে শ্রিয়ার সঙ্গে গাড়ি চালিয়ে ফিরছি, হঠাৎ খুব ভাজা কিছু একটা খেতে ইচ্ছে করছিল। সিগনালে দাঁড়িয়ে আমরা আলোচনা করছি কি কেনা যায়, হঠাৎ মনে হলো, সংহিতাদি থাকলে তো এসব কিছু ভাবতেই হতোনা, সোজা বাড়ি ঢুকে গা এলিয়ে বসে আবদার করতাম আর সে সব মিটেও যেত অক্লেশে। এই রকম একটা বাড়ি আমি বানাতে চাই। সেই খানে হয়তো কোনো রাতে একদল ছেলে মেয়ে বসে উদাত্ত স্বরে গাইবে তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি, ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে রাজি আছি॥ তখন চাঁদের নরম আলো ঘিরে ধরেছে চারদিক, বাইরে হাওয়া দিচ্ছে খুব, যে সব হাওয়ায় মন কেমন করে। বাড়ির এক কোণায় একটা ছোট্ট আরাম কেদারা, তার পাশের নাইট স্ট্যান্ড থেকে আলো পড়ছে চুঁইয়ে চুঁইয়ে, আর সংহিতাদি হাসছে, সেই ভুবনভোলানো হাসি। নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ। ভালো থেকো, সংহিতাদি।

সংহিতা দি, রিমেমব্রেন্স

এক সপ্তাহ হয়ে গেলো। অন্য দেশে চলে এসেছি, দূরত্ব দিয়ে ব্যবধান সৃষ্টি করি যতটা সম্ভব। বাড়িতে কিংবা শ্রিয়াকে ফোন করি, সবাই ভালো আছো তো? এরপরে ধীরে ধীরে জীবনে ব্যস্ত হয়ে যাবো। সবাই হয়ে যায়, অফিস, বৌ, বাচ্ছা, সংসার। শৈশব কৈশোরের সবটুকু জুড়ে ছিল দাদু, কলেজের শুরুতে চলে গেলো, ধীরে ধীরে ভুলেও গেলাম। দিদার মৃত্যু ছিল বড়োই আকস্মিক, চতুর্থীর দিনে সল্টলেক থেকে বারাসাতে ফিরছি, চারতলা থেকে হাত নাড়লো, তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস। ষষ্ঠীর দিন সকাল বেলায় শুনলাম সব শেষ।  ভুলে গেছি। এক ডিসেম্বরে দাদাভাইকে দেখে ফিরলাম আমেরিকায়, মার্চ কিংবা এপ্রিল মাসে চলে গেলো। ঠাম্মা ভুগলো বহুদিন, কতদিন শয্যাশায়ী, রেজিস্ট্রি করে ফিরলাম, শুনলাম চলে গেছে। বড়পিসিমণির পুরো ফ্যামিলিটা এক এক করে চলে গেলো, ছোটবেলায় সন্তুদাকে দেখে গল্পের বই পড়তে শেখা, আমার থেকে কতই বা বড়ো হবে, সেও চলে গেলো কত কম বয়সে। বাপ্পাকাকুকে দেখেছিলাম বিয়ের সময়ে, বললাম শরীরটা একটু খারাপ দেখাচ্ছে, ডাক্তার দেখিয়ো। চলে গেলো কোভিডের মাঝে। সবই ভুলে যাই, সময় ভুলিয়ে দেয় ধীরে ধীরে। সংহিতাদির মৃত্যুও ভুলে যাবো হয়তো, স্টেট কলেজের পাঁচটা বছর আর তার পরের পাঁচ, এইতো চেনাশোনা। কতদিনই বা মনে থাকবে। মাঝে মাঝে পাতা উল্টিয়ে ছবি টবি দেখবো। কিংবা হোয়াটসএপ খুললে দেখবো লেখা আছে উফ আর কত কাজ করবি, পম আসছে, রাতুল, সুপর্ণ, পান্ডা এসে পড়লো, একটু চা খেয়ে যা। ওটুকুই জ্বালাবে সারা জীবন। 

আমার দুঃখের দিন তথাগত

আমার সুখের দিন ভাসমান!

এমন বৃষ্টির দিন পথে পথে 

আমার মৃত্যুর দিন মনে পড়ে। 

আবার সুখের মাঠ ভরা জল

আবার দুঃখের ধান ভরে যায়!

এমন বৃষ্টির দিন মনে পড়ে

আমার জন্মের কোন শেষ নেই।

পপ কালচার, বাংলা সিনেমা

 বেশ কিছুদিন ধরে আমি ভাবছিলাম যে মানুষ এর ভ্যালু সিস্টেমকে এফেক্ট করা প্রায় অসম্ভব। উপরন্তু এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, যাতে আপনি কমফোর্টেবল ফিল করেন সেটাই চোখের সামনে আসে। এই বাবল এফেক্ট নিয়ে বিস্তর লেখালিখি হয়েছে। আমার ক্রমশঃই মনে হচ্ছিলো যে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক জিনিসপত্র নিয়ে কন্টেন্ট ক্রিয়েশন আদতে বৌদ্ধিক আত্মরতি। সময়বিশেষে মাস্টারবেশন অবশ্যই একটা ভালো স্ট্রেস রিলিজ, কিন্তু অন্য কারো জীবন এ তো এর কোনো এফেক্ট নেই!  


এই রকম সংশয়ের সময়ে, প্রায় অলৌকিক ভাবে ইউটিউব আমাকে একটি ভিডিও রেকমেন্ড করে। ভিডিওটি অসম্ভব ইরোটিক, আমি বিস্তৃত বিবরণে যাবোনা, তলায় লিংক আছে। শুতে যাওয়ার আগে অত্যন্ত ক্যাজুয়ালি ভিডিওটি চালিয়ে আমি প্রায় রুদ্ধশ্বাসে উঠে বসি, কারণ ভিডিওটি আশ্চর্য রকম ভাবে এন্টারটেনিং। ভিডিওর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক মহিলা, বেশ প্রভোকেটিভলি ড্রেসড, একা কথা বলে যাচ্ছেন। অস্বীকার করে লাভ নেই, মহিলাটি এতটা এট্রাকটিভ না হলে আমি হয়তো ভিডিওটি চালিয়েও দেখতাম না। সব মিলিয়ে, ভিডিওটি সস্তা থ্রিলারের মতন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চুম্বকের মতো টেনে রাখে।   


এবিগেল থর্ন ফিলোসফি টিউব বলে একটি ইউটিউব চ্যানেল চালান, যার সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ১.৫ মিলিয়ন, মানে পনেরো লক্ষ। পনেরো লক্ষ লোক তাঁর ভিডিওর জন্যে অপেক্ষা করে থাকে, যে ভিডিওর বিষয় হলো রিলেটিভিসম কিংবা এস্থেটিক্স। আমি যে ভিডিওটি প্রথম দেখি, তার বিষয় ছিল সোশ্যাল কন্সট্রাক্ট। এর পরে আমি বেশ তাড়াহুড়ো করেই এবিগেল এর অন্য ভিডিওগুলো দেখে ফেলি। 


প্যারাডক্স এখানেই যে আমি এবিগেল এর ভিডিও দেখেছি বিনোদনের একটা সোর্স হিসেবে, শুধুমাত্র জানার জন্যে নয়। এবিগেল পপ কালচার আইকন। তিনি জানেন সেক্স বিক্রি হয় সবচাইতে বেশী। শিল্প যত সস্তা, যত কম সেরিব্রাল এবং বেশী এন্টারটেইনিং, ততই বেশী সংখ্যক তার উপভোক্তা। কিন্তু এই সত্যিটাকে তিনি অস্ত্রের মতন ব্যবহার করেন। দু পয়সার নৌটঙ্কি দেখতে এসে মানুষ জিনিওলজি অফ মোরালিটির পাঠ নিয়ে ফিরে যায়।   


এবিগেল এর ভিডিও আমাকে পপ কালচার নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। পপ কালচার এর সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম আমি মনে করি সিনেমাকে। ঋত্ত্বিকই না বলে গেছিলেন সিনেমা করি কারণ তাতে সবচেয়ে বেশী মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়? এটা একটা অদ্ভুত মিডিয়াম। একটা বইতে লেখক তাঁর চিন্তা ভাবনা পাঠকের সঙ্গে ডিরেক্টলি কমিউনিকেট করতে পারেন। সিনেমাতে সেই সুযোগ নেই, কিন্তু পার্সপেক্টিভ এর ব্যবহার এর সুযোগ আছে। একটা ছোট উদাহরণ দিয়ে রাখি। গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা, কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা। সিনেমাতে প্রথম লাইনটা দেখানো সহজ। বৃষ্টি পড়ছে, মেঘে ঢাকা আকাশ। কিন্তু "নাহি ভরসা"র মধ্যে যে অসহায়তা রয়েছে সেইটা? এইবারে একটা ছবি কল্পনা করুন যেখানে একটা দিগন্তবিস্তৃত নদী দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে একটা কোণে একটা বিন্দু, যাকে মানুষ বলে চেনা যায়, কিন্তু খুব আবছা ভাবে। এই দূরত্ব, এই বিশালত্বের মধ্যে একটা ছোট্ট প্রেসেন্স, এইটা ইম্পরট্যান্ট। এটা আপনার মধ্যে একটা একাকিত্বের, ভরসাহীনতার সেন্স তৈরী করছে। এর পরে ক্যামেরা জুম করছে সেই বিন্দুর দিকে, আপনি মানুষটির মুখ দেখতে পাচ্ছেন, যেখানে একটা অসহায়তার ভাব ফুটে উঠছে। ফাইনালি, ক্যামেরা মানুষটির মুখ থেকে সরে ফোকাস করছে নদীর দিকে, সীমাহীন পারাপার। এইবার আপনার কাছে পুরোটা পরিষ্কার। একটি একাকী মানুষ সমুদ্রতীরে। বিষাদ ভারাক্রান্ত। প্রসঙ্গক্রমে, এই সিকোয়েন্সটি মনপুরা সিনেমার। 


সুতরাং সিনেমা, এট দ্য ভেরি লিস্ট, মানুষকে সাব কনশাশলি এফেক্ট করার একটা প্রসেস। পরিচালক অনেক কিছুই বলছেন, কিন্তু সোজাসুজি না। মোর ইম্পোর্ট্যান্টলি, পরিচালকের হাতে সুযোগ আছে এই প্রসেসটা কন্ট্রোল করার। এটা একটা আশ্চর্য ক্ষমতা। আপনি যদি লেখেন রহিম জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দিল, একটা হুলুস্থুলু পড়ে যাবে। কিন্তু একটা ফ্রেমে জাতীয় পতাকার ছবি ও পরের ফ্রেমে আগুন দেখালে আপনি কমপ্লিটলি সেফ। এই নয় যে বইতে বা নাটকে এই সাবটেক্সট থাকেনা, কিন্তু আমার পার্সোনালি মনে হয় সিনেমার ভেরি প্রসেসটাই যেমন সাবটেক্সট এর উপরে নির্ভর করে, অন্য মিডিয়ামে অতটাও নয়।


এখনো অব্দি দুটো জিনিস লিখেছি। পপ কালচার এর মধ্যে দিয়ে কিভাবে ইম্পরট্যান্ট মেসেজ এক্সপ্রেস করা যায় যা মানুষের ভ্যালু সিস্টেমকে এফেক্ট করতে পারে। এবং সিনেমা কিভাবে সাবকনসাসলি একটা মেসেজ ডেলিভার করে থাকে। যেটা বাকি রয়ে গেছে, সেটা হচ্ছে একটা কনেকশন। পপুলার কমার্শিয়াল বাংলা সিনেমা সাবকনসাসলি কি মেসেজ আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। ফড়িং কিংবা সহজ পাঠের গল্প: বেশ কিছু মাস্টারপিস এই রিসেন্ট সময়ে তৈরী হয়েছে, আমি সেগুলোর কথা বলছিনা। আমি বলছি কমার্শিয়াল বাংলা সিনেমা, বিজলি মিনার ছবিঘর কিংবা মফঃস্বলের হলে আলো জ্বালানো সিনেমার কথা। আমি জেনেরালাইজেশন করবো না কারণ সিনেমা আমার জীবিকা নয়, সুতরাং আমি খুব বেশী সিনেমা দেখিনা, বা আমার সিনেমা দেখার কোন ফর্মাল ট্রেনিংও নেই। প্রকৃত অর্থেই আমি এই আলোচনার অনধিকারী। কিন্ত দুটো সিনেমার, আরো স্পেসিফিকালি, দুটো গানের কম্পারিসন করে আমার যা মনে হয়েছে, সেটুকু লিখে রেখে যাই। সিনেমা শিক্ষিত লোকজন বিচার করবেন।  

  

বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে ভারতের সবচেয়ে বড় অবদান আইটেম ডান্স। পাঁচ থেকে দশ মিনিটের একটা সঙ্গীত ও নৃত্য মুখর সিকোয়েন্স, যার সঙ্গে একচুয়াল সিনেমার গল্পের কোনো সম্পর্ক নেই, এবং প্রায়শঃই গোটা সিনেমার কলা কুশলীদের ও কোনো সম্পর্ক নেই, সেরকম একটা জিনিস যে সিনেমাতে রাখা যেতে পারে শুধু বিনোদনের জন্যেই, এটা বলিউডের আগে কেউ করে দেখিয়েছে বলে মনে হয়না। ক্রিটিকদের ইউনিভার্সাল ঘৃণার এবং সাধারণ দর্শকের অবিমিশ্র ভালোবাসার এক দুর্ধর্ষ ককটেল, হোয়াট ইস মোর পপ কালচার দ্যান আইটেম ডান্স?


দুটো আইটেম সং আমি রিসেন্টলি খুব মন দিয়ে দেখেছি। প্রথমটা হচ্ছে একটা বাংলা সিনেমার যার নাম কেলোর কীর্তি। হিন্দিতে নো এন্ট্রি বলে একটা সিনেমা হয়েছিল। এই সিনেমাটি তার বাংলা ভার্সন। বাংলা গানটির নাম "হাটে বাজারে", এটি অরিজিনাল হিন্দি সিনেমাটির একটি গানের রিপ্লেসমেন্ট, যেটির নাম ছিল "ইশক দি গালি ভিজ নো এন্ট্রি"। বাংলা গানটির সুরকার ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত, লিরিসিস্ট প্রসেন, গেয়েছেন মধুবন্তী বাগচী, রানা মজুমদার ও কোরাস। নাচে মুখ্য ভূমিকায় নুসরত জাহান, দেব ও যীশু সেনগুপ্ত। আরেকটি গান অপেক্ষাকৃত বেশী বিখ্যাত। "দাবাং" সিনেমার এই গানটির নাম "ফেভিকল সে"। সুরকার গীতিকার সাজিদ ওয়াজিদ, গেয়েছেন ওয়াজিদ ও মমতা শর্মা। নাচের মূল কুশীলব করিনা কাপুর, সলমন খান ও আরবাজ খান।     

 

প্রথম প্রশ্ন হলো কম্পারিসন কেন বাংলা ও মূল হিন্দি গানের মধ্যে নয়। এই দুটো গান স্ট্রাকচারালি আলাদা। বাংলা গানটি নুসরতের ক্যারেক্টার (আমি এর পর থেকে এনাকে নুসরাত হিসেবেই লিখবো, কারণ আমি সিনেমাটা দেখিনি, সুতরাং ক্যারেক্টার এর নাম জানিনা) এর পার্সপেক্টিভ থেকে লেখা:  "হাটে বাজারে বেড়েছে বেজায় গরম, আমি যেইনা দুলিয়েছি কোমর নরম"। হিন্দি গানটির সেরকম কোন পার্সোনাল বক্তব্য নেই, বলা হচ্ছে প্রেমের গলিতে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। এই জন্যেই দ্বিতীয় গানটি চয়েস করা, যেটি শুরু হচ্ছে এইভাবে "আংড়াইয়া লেতি হুঁ ম্যায় জব জোর জোর সে", অর্থাৎ করিনার পার্সপেক্টিভ থেকে।


গানদুটির লিরিক্স এর সামান্য ভাষাতাত্বিক বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায় যে প্রথম গানটিতে দ্য এজেন্সি লাইজ উইথ নুসরাত। অর্থাৎ যা ঘটনা ঘটছে, তার পুরোটার কন্ট্রোল নুসরাতের হাতে। নুসরাত বলছেন কোমর দুলিয়েছি আমি, তার কন্সিকোয়েন্স এ বেড়েছে গরম। "আমারই সব দোষ, পোষায়না উপোস"। "পোষায়না উপোস" একটা আশ্চর্য শক্তিশালী ফ্রেজ। কমার্শিয়াল বাংলা সিনেমা, যার টার্গেট অডিয়েন্স গ্রাম মফস্বলের বাঙালি, সেখানে ফিমেল সেক্সুয়ালিটির এমন দ্বিধাহীন উদযাপন বিরল। এবং বিস্ময়কর ভাবে, এই থিমটা গোটা গান জুড়ে চলতে থাকে। "তাও আজ তোর সাথে জ্বলে পুড়ে যাবো, বলে বলে তোর কাছে আমি কেস খাব"। "তোর কাছে" কথাটা লক্ষ্যণীয়। বা "কত যে শহীদ আছে তোর নামে লেখা/ তাকালে কারেন্ট লাগে ছুঁয়ে দিলে ছ্যাঁকা"। এই প্রেমে নুসরাত ভিকটিম নন, বা তাঁর উপরে মেল ক্যারেক্টারদের স্যাটিসফাই করার দায়িত্বও নেই। তিনি এক্সিস্ট করেন প্রায় দেবত্বে, আফ্রোদিতির মতন। তাঁর সেক্সুয়ালিটি থেকে মেল্ ক্যারেক্টাররা প্লেজার ডিরাইভ করতে পারে, কিন্তু তিনি নিজে তাদেরকে সেই প্লেজার দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।


এর বিপ্রতীপে দেখি "ফেভিকল সে"র লিরিক্স। প্রথম কয়েকটি পংক্তি প্রায় অক্ষর এ অক্ষরে অনুবাদ। আমি যে দিকে যাই, হাঙ্গামা বেধে যায়। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় তার কয়েক লাইন পরেই। তোমার (পড়ুন মেল গেজ) এর স্যাটিস্ফেকশন এর জন্যে আমি আত্ম নিবেদন করতে তৈরী, আমাকে মিসড কল দিয়ে "পটিয়ে নাও"। এইখানে এজেন্সি সরে যায় করিনার থেকে মেল ক্যারেক্টারদের দিকে, এবং সেটা পরের লাইন গুলো জুড়ে চলতে থাকে। "তন্দুরি মুর্গি" লাইনটি বহু জায়গায় নিন্দিত হয়েছে, কিন্তু আমার মনে হয় তার চেয়ে ঢের অফেন্সিভ হলো এই গানের ওভারঅল থিম। প্রায় ত্রিশ পংক্তির গানে করিনা বহুবার পাওয়ার রেটোরিক ব্যবহার করেন: তাঁর যৌবন ধারালো, তিনি বরফে আগুন লাগাতে পারেন। কিন্তু সেই পজিশনেও তিনি নিজের প্রয়োজনের কথা বলেন না, বরং বিভিন্ন ইমেজারির মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দেন মেল স্যাটিস্ফেকশনের জন্যে বাবহৃত হওয়াতেই ফিমেল সেক্সুয়ালিটির সার্থকতা। 


যাঁরা গান লেখেন তাঁরা নিশ্চিত ভাবেই গানের পিকচারাইজেশন এর সঙ্গে যুক্ত থাকেন না। কিন্তু বিস্ময়কর ভাবে, লিঙ্গুইস্টিক এজেন্সির এই থিমাটিক পার্থক্য কোরিওগ্রাফিতে অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কোইন্সিডেন্টালি, দুটি গানেরই ৭ সেকেন্ডে আমরা মেন্ ক্যারেক্টারদের দেখি। প্রথম গানে ক্যামেরা ফোকাস করে নুসরাত এর মুখের উপরে, দ্বিতীয় গানে করিনার পিঠের উপরে। একটা অবভিয়াস পার্থক্য হলো প্রথম গানে এটা ইমিডিয়েটলি এস্টাব্লিশড হয় যে গানটির ফোকাস নুসরাত, দ্বিতীয় গানে করিনা একটি বিউটি মিথকে রিপ্রেজেন্ট করছেন, ওনার জায়গায় অন্য যে কেউ থাকতে পারতেন। কিন্তু আর একটা সাটল ডিফারেন্স রয়েছে। ক্যামেরা যখন নুসরাতের মুখের উপরে ফোকাস করে, তখন আমরা দেখছি এই সিচুয়েশনে নুসরত কিভাবে রিয়্যাক্ট করছেন। অর্থাৎ দর্শক গানটা নুসরাতের পার্সপেক্টিভ থেকে দেখতে শুরু করছেন, একদম প্রথম শটেই এজেন্সি এস্টাব্লিশড হয়ে যাচ্ছে। আমি জানিনা সেটা চয়েস না একসিডেন্ট, কিন্তু প্রথম গানে জুম্ শটের ব্যবহার অত্যন্ত বেশী, প্রথম এক মিনিটের মধ্যে ক্যামেরা অন্ততঃ পাঁচবার এক্সক্লুসিভলি নুসরাতের মুখের উপরে জুম করে। ৪ মিনিট ৩০ সেকন্ড লম্বা গোটা দ্বিতীয় গানে একটি মাত্র সিনে আমরা করিনার ফেস শট দেখতে পাই, ক্যামেরা কখনোই তাঁর বুকের উপরে ওঠেনা।  


গানদুটিতে প্রথম যে দুটি শটে আমরা মেল ও ফিমেল ক্যারেক্টারদের একসাথে দেখতে পাই, সে দুটি ওয়াইডলি ডিফারেন্ট। প্রথম গানে ক্যামেরা দেব ও নুসরাতকে একই প্লেনে ধরে, তাঁরা পাশাপাশি, একই উচ্চতায়, এবং ফোকাসের সামান্যই পার্থক্য। দ্বিতীয় গানে, প্রায় দশ সেকেন্ড ধরে আমরা সালমান খানকে দেখি, প্রায় সাররিয়েল ভাবে, করিনার কটিদেশ ও নিতম্বের ফাঁক দিয়ে। মেল্ ও ফিমেল ক্যারেক্টার এর এরকম প্রোনাউন্সড সাব্জেক্টিফিকেশন ও অব্জেক্টিফিকেশন নিজে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। গানটি যখন আমি প্রথম দেখি, তখন এটা আমি মিস করে গেছিলাম, অর্থাৎ এটা আমার মধ্যে রেজিস্টারই করেনি। এই ব্যাপার এ আমরা কিরকম ডিস্যানিটাইজড হয়ে গেছি ভাবা যায়! যাই হোক, এজেন্সি, আবার। 


সব মিলিয়ে, দ্বিতীয় গানটি ট্র্যাডিশনাল যৌনতা বিক্রি করছে সমাজের দাবী মেনে। কিন্তু প্রথম গানটি, সেই বিক্রির সাথে সাথেই, অত্যন্ত সাবভার্সিভ ভাবে, ভারী শক্তিশালী অল্টারনেটিভ ফেমিনিস্ট ভিউ রেখে যাচ্ছে দর্শকের মনে। অস্কার ওয়াইল্ড বলেছিলেন সেক্স ইস এবাউট পাওয়ার। সেই ট্র্যাডিশনাল পাওয়ার ইকুয়েশনটা উল্টে দিচ্ছে, অফ অল থিংস, একটি আইটেম সং। এইটাই পিওর জিনিয়াস। আমি বাংলা ও হিন্দি সিনেমার আইটেম সং এর কম্পারিজন করছিনা, যদিও সেটা পরে কখনো করার ইচ্ছে আছে। আমার বক্তব্য অন্য। এক্সপ্লিসিটলি ফিমেল পাওয়ার সেলিব্রেট করার গান পপুলার হিন্দি সিনেমাতেই রয়েছে, ব্রেক আপ সং, অনুষ্কা শর্মা ছিলেন মনে হয়। কিন্তু মানুষ আইটেম সং এ তার সোশিয়োপলিটিকাল চিন্তা ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করতে যাচ্ছেনা, বরং তার উল্টোটাই করতে যাচ্ছে। কিন্তু আমি দেখাতে চাই যে তার মধ্যেও সাবভার্সন সম্ভব, তার মধ্যেও মানুষকে সাবকনসাসলি অন্য রকম ভাবে চিন্তা করতে শেখানো সম্ভব। এবং বাংলাতেই সেই কাজ হচ্ছে।


ফাইনালি, আমি বিশ্বাস করি একটা মহৎ উদ্দেশ্য ছাড়া আর্ট মিনিংলেস। সেই জন্যেই, আমি প্রার্থনা করি, ফর্মের চক্রান্তে আমরা যেন না পড়ি। পপ কালচার এর অযুত সম্ভাবনার কথা আমরা যেন ভুলে না যাই। কিয়োরোস্তমির সিনেমা দেখতে গিয়ে আমরা যেন রাজ্ চক্রবর্তীকে অবজ্ঞা না করি। গোর্কির লেখা দিয়ে বিপ্লব শুরু হলে ভালো হতো, কিন্তু এই সময়ের মানুষ, আমার প্রতিবেশী, যদি গোর্কি না পড়ে, আমরা যেন তার থেকে মুখ ফিরিয়ে না নিই। বরং তার ড্যান ব্রাউন/সিডনি শেলডন লাইব্রেরিতে আমরা যেন গোর্কির বীজ পুঁতে দিয়ে আসতে পারি। 


ঋণস্বীকার: রণদীপ নস্কর বলে একটি বাচ্ছা ছেলে আমার ফেসবুক প্রোফাইলে আছে। ওকে ট্যাগ করে বিব্রত করলাম না। আমার সিনেমা দেখা, এস্পেশালি পপুলার সিনেমা দেখতে শেখা সম্পূর্ণ ভাবে ওর লেখা পড়ে। এই ছেলেটি বড়ো হয়ে যদি ফিল্ম মেকার বা ক্রিটিক না হতে পারে, এই সমাজের জন্যে অত্যন্ত লজ্জার ব্যাপার হবে।


স্টেট কলেজ, পুজো, নাটক

এই বার আর স্টেট কলেজ এর পুজোয় যাওয়া হলোনা। মন খারাপ। গেলেও হয়তো পুরোনো বন্ধু বান্ধব, সংহিতাদির কথা মনে পড়তো, কষ্ট হতো। 

স্টেট কলেজের পুজো বললেই পুজোর নাটকের কথা মনে পড়ে। প্রত্যেক বছরের এটাই একটা দারুণ আকর্ষণ ছিল। এই ছবিটা ২০১৫ সালের নাটক এর, এর সঙ্গে কত মজার স্মৃতি জড়িয়ে আছে ভাবলেও অবাক লাগে।

আমাদের নাটক লেখার শুরুটা খুব অদ্ভুত। সরস্বতী পুজোর কালচারাল প্রোগ্রামের রিহার্সাল হচ্ছিলো, অহনা এসেছিল গান প্র্যাকটিস করতে, অভিনন্দন কি একটা করছিলো মনে নেই। ৭০৭ এর ডাইনিং টেবলে দুজনকে পাশাপাশি দেখে মনে হলো, আরে এদেরতো একসঙ্গে মানাবে ভালো, চৈনিক মেয়ের নকশাল প্রেমিক! সেই নিয়েই আমরা একটা ছোট্ট স্কিট লিখলাম। দেবাঞ্জন ছিল বুম্বাদা, একাই ইন্ডাস্ট্রি। আর সিদ্ধার্থ খড়্গপুরে নাটক করতো, পুলিশ অফিসার বা গোয়েন্দার রোলে ওকে দারুণ লাগতো। ওদেরকে নিয়ে আরো দু একটা জিনিস জুড়ে দেওয়া হলো, স্টেট কলেজের বাস সিস্টেমটাকে বলে ক্যাটাবাস, তাই নিয়ে অত্রিয় একটা বাংলা র্যাপ লিখলো, সব মিলিয়ে ভালোই খিচুড়ি।

২০১৫ সালে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো। এর আগে প্রত্যেক বছরই নাটক করার জন্যে লোকজনকে সাধতে হতো, সেইবারে এতো লোকে উৎসাহী হলো, সবাইকে জায়গা দেওয়ার মতন নাটক খুঁজে পাওয়া যায়না। আমরা কিন্তু তার আগেই ডিসাইড করেছিলাম পুজোতে যে যা করতে চাইবে করতে দেওয়া হবে, কোয়ালিটি ইত্যাদি নিয়ে অত মাথা ব্যাথা ছিলোনা, বাদল সরকার হতে তো চাইছিনা। কিন্তু কিছু প্র্যাকটিকাল সমস্যা আছে, কালচারাল প্রোগ্রামের শেষ অংশ হচ্ছে নাটক, তারপরেই বিরিয়ানি। দর্শকের ধৈর্য্য কিছু কোলকাতার গলিপথের ফাটল নয় যে দশকে দশকে বাড়তে থাকবে। এস্পেশালি সুখাদ্যের সঙ্গতে। সুতরাং পয়ঁতাল্লিশ মিনিটের নাটকে পনেরোটি ক্যারেক্টার ঢোকানো প্রয়োজন, এবং মহিলা ক্যারেক্টার সংখ্যায় কম, তখনো কেন জানি পার্টিসিপেশন এর জেন্ডার রেশিও অত্যন্ত স্কিউড ছিল। স্টেজ বলে কিছু নেই, চারটি স্পটলাইট, সেটাই দর্শক ও স্টেজ এর ডিভিশন। প্রপস ও মেক আপ এর বাজেট কুড়ি পঁচিশ ডলার। মাইক ক্যাচার ইত্যাদির তো প্রশ্নই নেই।  

এতো সমস্যার একটাই সমাধান, নিজেদের নাটক নিজেরা লেখা। অগস্টের শুরুতে সবাই মিলে কোথাও একটা নৌকাভ্রমণ করতে যাওয়া হয়েছিল, সেই নৌকাতে বসেই নাটকের জেনারেল প্লট ঠিক হলো। একটা হুডানইট গোয়েন্দা গল্প, কিন্তু ফাইনালি একটা কমেডি।

এই নাটকটা মনে হয় প্রথম লেখা হয়েছিল একটা উইকেন্ডে, চল্লিশ মিনিটের নাটক লিখতে কতই বা সময় লাগে। বনেদী বাড়িতে পুরোনো আমলের একটা কয়েন, ইনসিওর করা হবে বলে এজেন্টকে ডাকা হয়েছে। সেটাই চন্দ্রগুপ্তের চার আনা। এজেন্ট এর সঙ্গে এসেছে স্যাকরা। বাড়ির ক্যারেক্টার বলতে গুরু গম্ভীর কর্তামশাই, তাঁর কুলাঙ্গার মাতাল ভাই, ভাই এর লক্ষীমন্ত বৌ, কর্তার সেক্রেটারি, এবং চাকর। এনারা সবাই যখন একসাথে একটি বসে, মাঝখানে টেবিলে কয়েনটি সাজানো, হঠাৎ লোড শেডিং। আলো জ্বললে দেখা যায় কয়েনটা নেই। রহস্য সমাধানে প্রথমে আসে দুই পুলিশ, তারপরে ডিটেকটিভ ও তার এসিস্ট্যান্ট। ডিটেকটিভ ও এসিস্টেন্ট এর সাথে বাকি ক্যারেক্টারদের ছোট্ট ছোট্ট ইন্টারভিউ সিন। ফাইনালি শেষ সিনে রহস্য সমাধান। একাঙ্ক নাটক, পর্দা টর্দা নেই, লাইট অন অফ করেই সিন ডিমার্কেশন।  

আমাদের সময়ে যারা স্টেট কলেজে ছিল, তারা নাটক না দেখলেও মোটামুটি আন্দাজ করে নিতে পারবে কে কোন ক্যারেক্টার এ যাবে। গুরুগম্ভীর লোক বললে প্রথমেই মনে আসবে সুপর্ণর কথা, যে চেপে হাসলেও মনে হয় মেঘ ডাকছে। পার্মানেন্ট মাতাল ছিল অনুপম, যার বাড়িতে যে কোনো সময়ে ত্রিশ লিটার মদ থাকতো। বনেদী বাড়ির জাঁদরেল বৌ হিসেবে অহনা ছিল পারফেক্ট, ওই ষ্টার জলসায় যাদের আঁচলে চাবি বাঁধা থাকে। রিলায়াবিলিটির ডেফিনিশন ছিল অর্পণ, ওকে ছাড়া আর কাকেই বা ভাবা যায় ইনসিওরেন্স এজেন্ট হিসেবে। চাকর এর রোলটা ছোট্ট কিন্তু অসম্ভব ভাইটাল, সত্য ছিল একদম পারফেক্ট চয়েস। সিদ্ধার্থ আর দেবাঞ্জন দুজনেই তখন খুব ব্যস্ত, ওদের জন্যে ছোট্ট দুটো পুলিশের রোল লেখা হয়েছিল। দেবাঞ্জন ছিল ক্যালিফোর্নিয়ায়, নাটকের আগের দিন এসে পৌঁছয়। তার আগে ওর সঙ্গে জুমে এক দু বার রিহার্সাল হয়েছিল, তখন অতিমারী ইত্যাদি আসেনি, তাও। ডিটেকটিভ এর রোলে ছিল অত্রিয়, আর সেক্রেটারির চরিত্রে রাতুল। স্যাকরার চরিত্রটা লেখা হয়েছিল বাঙাল এক্সেন্টে, এবং একমাত্র পার্থদাই সে রোলটা করতে পারতো। দুটো সিনের মধ্যে অন্ধকার, সেই সময়ে মিউজিক বাজবে, তার দায়িত্ত্বে ছিল পরমাদি।   

অজস্র অসুবিধার মধ্যেও আমাদের এই একটা মস্ত সুবিধে ছিল। যাদের সাথে নাটক করছি তাদের প্রত্যেককে এতটাই কাছ থেকে চিনতাম যে কে কোন কথাটা কিভাবে বলতে পারে সেটা আগে থেকেই সহজে আন্দাজ করা যেত। সবার হাঁটা চলা, আচার আচরণ খুব সহজ ভাবেই মাথার মধ্যে ছবির মতো থাকতো। রাতুল যখন প্রথম এলো, বড়ো চুল ছিল নজরুলের মতন, চাপ দাড়ি, কটা চোখ, একেবারে সেন্ট পল্স এ ঝোলানো যীশুর ছবি। ওর জন্যে যীশুখৃষ্টের রোল লেখা হয়েছিল একটা নাটকে। সোমঋতা বাইরে থেকে দেখতে খুবই শান্ত, আমি যেদিন ওকে প্রথম দেখি সেদিন ও আলাস্কার হোটেল এ বসে মেগাবাস এর এক কর্মচারীর উপরে অসম্ভব চিৎকার চেঁচামেচি করছিলো। সেইদিন থেকেই জানি ওর জন্যে একটা দজ্জাল বৌ এর ক্যারেক্টার লেখা দরকার। 

পৃথিবীতে এই একমাত্র নাটক যা মঞ্চস্থ হবার আগের দিন পর্যন্ত পাল্টেছে। নাটকের ভিলেন, অর্থাৎ যে কিনা কয়েনটা চুরি করেছে, তার ক্যারেক্টার তো এতবার পাল্টেছে যে আমার মনেই নেই অরিজিনালি কি বা কাকে ভাবা হয়েছিল। রিহার্সালে ঢোকার সময়ে ভেবে ঢুকলাম যে আজকে এটলিস্ট তিনটে সিন করা হবে, প্রথম সিন পেরোতেই সবাই হতোদ্যম। খুব ভেবে চিন্তে কমিক রিলিফ হিসেবে লিখেছি একটা ডায়ালগ, আয়রনিকালি সেটা বড়ো লিটারাল সেন্সে দাঁড়িয়ে গিয়েছে, মানে গোটা নাটকটাই একটা কমিক, মাঝখানে ঐটুকু শুধু রিলিফ। বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার লিখি, পাল্টাই। একটা জায়গায় অনুপম এর বলার কথা "আপনি কি আমাকে চ্যালেঞ্জ করছেন?" তার বদলে ও ফ্ল্যাশ ডান্স শুরু করে "চ্যালেঞ্জ নিবিনা শালা"। অত্রিয়র পরে আমার ডায়ালগ, কিন্তু ওর পস আর শেষ হয়না। কানে পেন নিয়ে ক্রমাগতঃ হেঁটে যায় ঘরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। খানিক পরে বুঝি ডায়ালগটা ভুলে গিয়েছে, কিন্তু ক্যারেক্টার ব্রেক করতে চাইছেনা। বড়ো এক্টর। একমাত্র দর্শক সংহিতাদি, হাহা হিহি করে যায় সব সময়ে। সঙ্গে গুলতানি করে রাতুল আর অর্পণ। অহনা একটু প্রফেশনাল, বিরক্ত হয়ে বলে আমাকে আগে ছেড়ে দাও সাগ্নিকদা। 

নাটকটা স্টেজে কেমন হয়েছিল একজ্যাক্টলি মনে নেই, কিছু ক্রুশিয়াল জিনিসপত্র আশ্চর্য লাকে ম্যানেজ হয়েছিল এটুকু মনে আছে। কিন্তু রিহার্সালের এই মুহূর্তগুলো, একসাথে বসে লেখালেখির মুহূর্তগুলো, হাসি, গল্প, মান অভিমানের মুহূর্তগুলো ছবির মতন ভেসে ওঠে। আমরা সব সময়ই খুব সহজ, এন্টারটেইনিং এবং মজার জিনিসপত্র লেখার চেষ্টা করেছি। একটা কারণ অবশ্যই যে চাইলেও কঠিন কিছু করতে পারতাম না, সেরকম পড়াশুনো তো করিনি। আরেকটা কারণ খুবই স্বার্থপর: আমরা চাইতাম নাটকের রিহার্সালগুলো যেন এক একটা আশ্চর্য মজার অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। কারণ নাটক তো একদিনের, তিরিশটা মিনিট। জার্নিটা তো সময়হীন। রক্তকরবী করলে কি সেই গল্প গুলো তৈরী হতো? হয়তো হতো, এখন তো আর ফিরে করা সম্ভব নয়।

এখানে যাদের নাম লিখেছি, সকলেই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। বেশ কিছু জনের সাথে বহুদিন যোগাযোগ নেই, সংহিতাদির সাথে তো আর সে সুযোগও নেই। আমাদের সব কিছু জুড়ে ছিল সংহিতাদি, সকল অভাব অনুযোগের অন্নপূর্ণা। এই নাটকের যে মেন প্রপ, যে কয়েন, সেটাই এতো যত্ন করে বানিয়েছিল, কার কাছে রয়ে গেছে, কিংবা আদৌ আছে কিনা জানিনা। স্টেট কলেজ হয়তো আছে তার মতনই, প্রতি বছর নতুন ছেলে মেয়েরা আসছে, কত নতুন নতুন মুহূর্ত তৈরী হচ্ছে; আমরা যাইনি ম’রে আজো— তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়। 

যারা আজকে এই আশ্চর্য শহরের ক্যাফেতে মোড়েতে বসে আছো, তাদের জন্যে অনেক অনেক ভালোবাসা। খুব সুন্দর একটা পুজো হোক, খুব সুন্দর একটা নাটক হোক, কালচারাল প্রোগ্রাম হোক, আর সব কিছুর উপরে অনেক অনেক গল্প তৈরী হোক, যার দিকে সারা জীবন তাকিয়ে বলতে পারবে, একটা দারুণ সময় কাটিয়েছিলাম। ফড়িং এর ডানাতেও এ জীবন দেয় ডাক, বেঁচে থাক সব্বাই, হাতে হাত রাখা থাক। শুভ শারদীয়া।