Sunday, November 21, 2021

স্টেট কলেজ, পুজো, নাটক

এই বার আর স্টেট কলেজ এর পুজোয় যাওয়া হলোনা। মন খারাপ। গেলেও হয়তো পুরোনো বন্ধু বান্ধব, সংহিতাদির কথা মনে পড়তো, কষ্ট হতো। 

স্টেট কলেজের পুজো বললেই পুজোর নাটকের কথা মনে পড়ে। প্রত্যেক বছরের এটাই একটা দারুণ আকর্ষণ ছিল। এই ছবিটা ২০১৫ সালের নাটক এর, এর সঙ্গে কত মজার স্মৃতি জড়িয়ে আছে ভাবলেও অবাক লাগে।

আমাদের নাটক লেখার শুরুটা খুব অদ্ভুত। সরস্বতী পুজোর কালচারাল প্রোগ্রামের রিহার্সাল হচ্ছিলো, অহনা এসেছিল গান প্র্যাকটিস করতে, অভিনন্দন কি একটা করছিলো মনে নেই। ৭০৭ এর ডাইনিং টেবলে দুজনকে পাশাপাশি দেখে মনে হলো, আরে এদেরতো একসঙ্গে মানাবে ভালো, চৈনিক মেয়ের নকশাল প্রেমিক! সেই নিয়েই আমরা একটা ছোট্ট স্কিট লিখলাম। দেবাঞ্জন ছিল বুম্বাদা, একাই ইন্ডাস্ট্রি। আর সিদ্ধার্থ খড়্গপুরে নাটক করতো, পুলিশ অফিসার বা গোয়েন্দার রোলে ওকে দারুণ লাগতো। ওদেরকে নিয়ে আরো দু একটা জিনিস জুড়ে দেওয়া হলো, স্টেট কলেজের বাস সিস্টেমটাকে বলে ক্যাটাবাস, তাই নিয়ে অত্রিয় একটা বাংলা র্যাপ লিখলো, সব মিলিয়ে ভালোই খিচুড়ি।

২০১৫ সালে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো। এর আগে প্রত্যেক বছরই নাটক করার জন্যে লোকজনকে সাধতে হতো, সেইবারে এতো লোকে উৎসাহী হলো, সবাইকে জায়গা দেওয়ার মতন নাটক খুঁজে পাওয়া যায়না। আমরা কিন্তু তার আগেই ডিসাইড করেছিলাম পুজোতে যে যা করতে চাইবে করতে দেওয়া হবে, কোয়ালিটি ইত্যাদি নিয়ে অত মাথা ব্যাথা ছিলোনা, বাদল সরকার হতে তো চাইছিনা। কিন্তু কিছু প্র্যাকটিকাল সমস্যা আছে, কালচারাল প্রোগ্রামের শেষ অংশ হচ্ছে নাটক, তারপরেই বিরিয়ানি। দর্শকের ধৈর্য্য কিছু কোলকাতার গলিপথের ফাটল নয় যে দশকে দশকে বাড়তে থাকবে। এস্পেশালি সুখাদ্যের সঙ্গতে। সুতরাং পয়ঁতাল্লিশ মিনিটের নাটকে পনেরোটি ক্যারেক্টার ঢোকানো প্রয়োজন, এবং মহিলা ক্যারেক্টার সংখ্যায় কম, তখনো কেন জানি পার্টিসিপেশন এর জেন্ডার রেশিও অত্যন্ত স্কিউড ছিল। স্টেজ বলে কিছু নেই, চারটি স্পটলাইট, সেটাই দর্শক ও স্টেজ এর ডিভিশন। প্রপস ও মেক আপ এর বাজেট কুড়ি পঁচিশ ডলার। মাইক ক্যাচার ইত্যাদির তো প্রশ্নই নেই।  

এতো সমস্যার একটাই সমাধান, নিজেদের নাটক নিজেরা লেখা। অগস্টের শুরুতে সবাই মিলে কোথাও একটা নৌকাভ্রমণ করতে যাওয়া হয়েছিল, সেই নৌকাতে বসেই নাটকের জেনারেল প্লট ঠিক হলো। একটা হুডানইট গোয়েন্দা গল্প, কিন্তু ফাইনালি একটা কমেডি।

এই নাটকটা মনে হয় প্রথম লেখা হয়েছিল একটা উইকেন্ডে, চল্লিশ মিনিটের নাটক লিখতে কতই বা সময় লাগে। বনেদী বাড়িতে পুরোনো আমলের একটা কয়েন, ইনসিওর করা হবে বলে এজেন্টকে ডাকা হয়েছে। সেটাই চন্দ্রগুপ্তের চার আনা। এজেন্ট এর সঙ্গে এসেছে স্যাকরা। বাড়ির ক্যারেক্টার বলতে গুরু গম্ভীর কর্তামশাই, তাঁর কুলাঙ্গার মাতাল ভাই, ভাই এর লক্ষীমন্ত বৌ, কর্তার সেক্রেটারি, এবং চাকর। এনারা সবাই যখন একসাথে একটি বসে, মাঝখানে টেবিলে কয়েনটি সাজানো, হঠাৎ লোড শেডিং। আলো জ্বললে দেখা যায় কয়েনটা নেই। রহস্য সমাধানে প্রথমে আসে দুই পুলিশ, তারপরে ডিটেকটিভ ও তার এসিস্ট্যান্ট। ডিটেকটিভ ও এসিস্টেন্ট এর সাথে বাকি ক্যারেক্টারদের ছোট্ট ছোট্ট ইন্টারভিউ সিন। ফাইনালি শেষ সিনে রহস্য সমাধান। একাঙ্ক নাটক, পর্দা টর্দা নেই, লাইট অন অফ করেই সিন ডিমার্কেশন।  

আমাদের সময়ে যারা স্টেট কলেজে ছিল, তারা নাটক না দেখলেও মোটামুটি আন্দাজ করে নিতে পারবে কে কোন ক্যারেক্টার এ যাবে। গুরুগম্ভীর লোক বললে প্রথমেই মনে আসবে সুপর্ণর কথা, যে চেপে হাসলেও মনে হয় মেঘ ডাকছে। পার্মানেন্ট মাতাল ছিল অনুপম, যার বাড়িতে যে কোনো সময়ে ত্রিশ লিটার মদ থাকতো। বনেদী বাড়ির জাঁদরেল বৌ হিসেবে অহনা ছিল পারফেক্ট, ওই ষ্টার জলসায় যাদের আঁচলে চাবি বাঁধা থাকে। রিলায়াবিলিটির ডেফিনিশন ছিল অর্পণ, ওকে ছাড়া আর কাকেই বা ভাবা যায় ইনসিওরেন্স এজেন্ট হিসেবে। চাকর এর রোলটা ছোট্ট কিন্তু অসম্ভব ভাইটাল, সত্য ছিল একদম পারফেক্ট চয়েস। সিদ্ধার্থ আর দেবাঞ্জন দুজনেই তখন খুব ব্যস্ত, ওদের জন্যে ছোট্ট দুটো পুলিশের রোল লেখা হয়েছিল। দেবাঞ্জন ছিল ক্যালিফোর্নিয়ায়, নাটকের আগের দিন এসে পৌঁছয়। তার আগে ওর সঙ্গে জুমে এক দু বার রিহার্সাল হয়েছিল, তখন অতিমারী ইত্যাদি আসেনি, তাও। ডিটেকটিভ এর রোলে ছিল অত্রিয়, আর সেক্রেটারির চরিত্রে রাতুল। স্যাকরার চরিত্রটা লেখা হয়েছিল বাঙাল এক্সেন্টে, এবং একমাত্র পার্থদাই সে রোলটা করতে পারতো। দুটো সিনের মধ্যে অন্ধকার, সেই সময়ে মিউজিক বাজবে, তার দায়িত্ত্বে ছিল পরমাদি।   

অজস্র অসুবিধার মধ্যেও আমাদের এই একটা মস্ত সুবিধে ছিল। যাদের সাথে নাটক করছি তাদের প্রত্যেককে এতটাই কাছ থেকে চিনতাম যে কে কোন কথাটা কিভাবে বলতে পারে সেটা আগে থেকেই সহজে আন্দাজ করা যেত। সবার হাঁটা চলা, আচার আচরণ খুব সহজ ভাবেই মাথার মধ্যে ছবির মতো থাকতো। রাতুল যখন প্রথম এলো, বড়ো চুল ছিল নজরুলের মতন, চাপ দাড়ি, কটা চোখ, একেবারে সেন্ট পল্স এ ঝোলানো যীশুর ছবি। ওর জন্যে যীশুখৃষ্টের রোল লেখা হয়েছিল একটা নাটকে। সোমঋতা বাইরে থেকে দেখতে খুবই শান্ত, আমি যেদিন ওকে প্রথম দেখি সেদিন ও আলাস্কার হোটেল এ বসে মেগাবাস এর এক কর্মচারীর উপরে অসম্ভব চিৎকার চেঁচামেচি করছিলো। সেইদিন থেকেই জানি ওর জন্যে একটা দজ্জাল বৌ এর ক্যারেক্টার লেখা দরকার। 

পৃথিবীতে এই একমাত্র নাটক যা মঞ্চস্থ হবার আগের দিন পর্যন্ত পাল্টেছে। নাটকের ভিলেন, অর্থাৎ যে কিনা কয়েনটা চুরি করেছে, তার ক্যারেক্টার তো এতবার পাল্টেছে যে আমার মনেই নেই অরিজিনালি কি বা কাকে ভাবা হয়েছিল। রিহার্সালে ঢোকার সময়ে ভেবে ঢুকলাম যে আজকে এটলিস্ট তিনটে সিন করা হবে, প্রথম সিন পেরোতেই সবাই হতোদ্যম। খুব ভেবে চিন্তে কমিক রিলিফ হিসেবে লিখেছি একটা ডায়ালগ, আয়রনিকালি সেটা বড়ো লিটারাল সেন্সে দাঁড়িয়ে গিয়েছে, মানে গোটা নাটকটাই একটা কমিক, মাঝখানে ঐটুকু শুধু রিলিফ। বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার লিখি, পাল্টাই। একটা জায়গায় অনুপম এর বলার কথা "আপনি কি আমাকে চ্যালেঞ্জ করছেন?" তার বদলে ও ফ্ল্যাশ ডান্স শুরু করে "চ্যালেঞ্জ নিবিনা শালা"। অত্রিয়র পরে আমার ডায়ালগ, কিন্তু ওর পস আর শেষ হয়না। কানে পেন নিয়ে ক্রমাগতঃ হেঁটে যায় ঘরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। খানিক পরে বুঝি ডায়ালগটা ভুলে গিয়েছে, কিন্তু ক্যারেক্টার ব্রেক করতে চাইছেনা। বড়ো এক্টর। একমাত্র দর্শক সংহিতাদি, হাহা হিহি করে যায় সব সময়ে। সঙ্গে গুলতানি করে রাতুল আর অর্পণ। অহনা একটু প্রফেশনাল, বিরক্ত হয়ে বলে আমাকে আগে ছেড়ে দাও সাগ্নিকদা। 

নাটকটা স্টেজে কেমন হয়েছিল একজ্যাক্টলি মনে নেই, কিছু ক্রুশিয়াল জিনিসপত্র আশ্চর্য লাকে ম্যানেজ হয়েছিল এটুকু মনে আছে। কিন্তু রিহার্সালের এই মুহূর্তগুলো, একসাথে বসে লেখালেখির মুহূর্তগুলো, হাসি, গল্প, মান অভিমানের মুহূর্তগুলো ছবির মতন ভেসে ওঠে। আমরা সব সময়ই খুব সহজ, এন্টারটেইনিং এবং মজার জিনিসপত্র লেখার চেষ্টা করেছি। একটা কারণ অবশ্যই যে চাইলেও কঠিন কিছু করতে পারতাম না, সেরকম পড়াশুনো তো করিনি। আরেকটা কারণ খুবই স্বার্থপর: আমরা চাইতাম নাটকের রিহার্সালগুলো যেন এক একটা আশ্চর্য মজার অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। কারণ নাটক তো একদিনের, তিরিশটা মিনিট। জার্নিটা তো সময়হীন। রক্তকরবী করলে কি সেই গল্প গুলো তৈরী হতো? হয়তো হতো, এখন তো আর ফিরে করা সম্ভব নয়।

এখানে যাদের নাম লিখেছি, সকলেই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। বেশ কিছু জনের সাথে বহুদিন যোগাযোগ নেই, সংহিতাদির সাথে তো আর সে সুযোগও নেই। আমাদের সব কিছু জুড়ে ছিল সংহিতাদি, সকল অভাব অনুযোগের অন্নপূর্ণা। এই নাটকের যে মেন প্রপ, যে কয়েন, সেটাই এতো যত্ন করে বানিয়েছিল, কার কাছে রয়ে গেছে, কিংবা আদৌ আছে কিনা জানিনা। স্টেট কলেজ হয়তো আছে তার মতনই, প্রতি বছর নতুন ছেলে মেয়েরা আসছে, কত নতুন নতুন মুহূর্ত তৈরী হচ্ছে; আমরা যাইনি ম’রে আজো— তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়। 

যারা আজকে এই আশ্চর্য শহরের ক্যাফেতে মোড়েতে বসে আছো, তাদের জন্যে অনেক অনেক ভালোবাসা। খুব সুন্দর একটা পুজো হোক, খুব সুন্দর একটা নাটক হোক, কালচারাল প্রোগ্রাম হোক, আর সব কিছুর উপরে অনেক অনেক গল্প তৈরী হোক, যার দিকে সারা জীবন তাকিয়ে বলতে পারবে, একটা দারুণ সময় কাটিয়েছিলাম। ফড়িং এর ডানাতেও এ জীবন দেয় ডাক, বেঁচে থাক সব্বাই, হাতে হাত রাখা থাক। শুভ শারদীয়া।

No comments: