Sunday, November 21, 2021

স্টেট কলেজ, পুজো

খেতে বসে ঋতুপর্ণ ঘোষের একটা সিনেমা চালিয়েছিলাম। উৎসব। অনেকবার দেখা সিনেমা, তবুও ভাবলাম একটু দেখি। ঋতুপর্ণ অসামান্য স্টোরিটেলার, তাঁর সিনেমা দেখতে শুরু করলে থামা যায়না। দেখা শেষ হতে মনে হলো, আমাদের উৎসব তো চলে এলো। পৃথিবীর গভীর অসুখ এখন, এই সব হই হট্টগোল নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায় মানুষের। তবু বৃষ্টি থেমে মাঝে মাঝে বল্লমের ফলার মতো উঁকি দেয় শরতের রোদ্দুর, ঘন কংক্রিটের জঙ্গলে আচমকা শিউলির সুবাতাস বয় আর বাঙালীর মন কেমন করে ওঠে। মা আসছেন। ওই শোনো শূন্যপথে রথচক্র-ধ্বনি, ও নহে শারদ মেঘে লঘু গরজন; ছাড়িয়া অনন্তধাম সৌন্দর্য-কৈলাশ, আসিছেন এ বঙ্গের আনন্দ-রূপিনী।

আমার কাছে পুজো মানে স্টেট কলেজ। সেই যে একদিন রাত্তির এগারোটার সময় ছোট্ট একটা প্লেনে চড়ে একটা অন্ধকার ততোধিক ছোট এয়ারপোর্টে নামলাম, ভাবতেই পারিনি একদিন ছাড়ার সময়ে প্রাণটা একেবারে কেঁদে উঠবে। চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটা গ্রাম, সেগুলোকে পাহাড় বললে ভুল হবে, টিলা গোছের। কিন্তু একেবারে ন্যাড়া নয়, এলোমেলো সবুজ ও খয়েরি, প্রথম যৌবনের মতো উদ্দাম। সেখানে আকাশ কী ভীষণ তীব্র নীল আর চারিদিক চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো সবুজ। মধ্যে মধ্যে নিকোনো রাস্তাঘাট আর তার দুইপাশে একতলা দোতলা বাড়ি ও বাগান, তাতে অপ্সরাবিভঙ্গী লতা ও ফুলের কেয়ারী। মোট কথা প্রথম দর্শনেই ঝট করে প্রেমে পড়ে গেলাম। 

অগস্ট মাসের শেষে একটা গেট টুগেদার হলো, সেখানে লোকজনের সাথে প্রথম আলাপ, আর পুজোর দিন টিন ঠিক করা হলো। দেখলাম একজন নাম ধাম লিখে নিলো কে কি করতে পারে, আমি ছোটবেলায় পেপার কেটে নকশা বানাতাম, খুব উৎসাহের সাথে নাম দিয়ে দিলাম। তারপরে আর কথাবার্তা নেই, ভাবলাম ভালোই হলো, আমি খুব একটা সদালাপী মানুষ নই, পুজোয় না হয় একাই একটু রান্নাবান্না করে খেয়ে নেব। সেইমতো কাছের একটা শহর থেকে গিয়ে বরফ জমা ইলিশ মাছও নিয়ে এলাম। পুজোর আগের দিন সন্ধেবেলায় কিন্তু ফোন এলো, আর তারপরে কে একটা গাড়ি করে একটা ইস্কুল বিল্ডিং এর মধ্যে ঢুকিয়ে কেটে পড়লে। সেখানে ঢুকে দেখি একটা হলঘরের মধ্যে ভয়ানক দক্ষযজ্ঞ চলছে। কেউ মন দিয়ে ছবি আঁকছে, কেউ ঝাঁটা হাতে ঘর পরিষ্কার করছে, ঘরের মাঝখানে একদঙ্গল ছেলেপুলে মিলে বোধহয় নাটকের রিহার্সাল দিচ্ছে কিন্তু সেদিকে আমাকে কেউ ঘেঁষতেই দিলেনা কারণ তাতে এক্সক্লুসিভিটি নষ্ট হয়ে যাবে। বিমর্ষ হয়ে বসে অপমানের পরিমাপ করছি, ডেকোরেশনের দ্বায়িত্ত্বে যে ছেলেটি ছিল সে বললে আরে তুই পেপার কাটিং করবি না? চল কি লাগবে কিনে নিয়ে আসি। আবার গাড়ি চড়ে চল্লুম, সঙ্গে আরেকজন দাদা, তাঁর আসার উদ্দেশ্য প্রথমে বুঝিনি, একটু পরেই পরিষ্কার হলো। এ দোকান ও দোকান ঘুরে যাই কিনতে যাই, দাদাটি মুখ গোমড়া করে মাথা নাড়েন, বাজেটে কুলোবেনা। উনি ফাইনান্স মিনিস্ট্রিতে ছিলেন আর কি। যাই হোক যা কিছু একটা কিনে ঢুকতেই দেখলাম ঘরের এক দেয়াল জুড়ে অধিষ্ঠান করে আছেন সে কি ভীষণ মিষ্টি একটি একচালার ঠাকুর, তাঁর হাইট তিনফুট হলে কি হবে, অলঙ্কারের খামতি নেই, এমনকি গণেশের ইঁদুরের ল্যাজটুকু পর্যন্ত বড়ো যত্ন করে গড়া। এই ঠাকুর কালকে বিসর্জন হয়ে যাবে ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে গেছিলো, কিন্তু একজন খুবই আশ্বাস দিয়ে জানালেন এখানে বিসর্জন হয়না, ফি-বচ্ছর একই মাতৃপ্রতিমা, পুজো শেষে আবার এনাকে যত্ন করে তুলে রেখে দেওয়া হবে। তারপরে ভীষণ হুলুস্থুলু করে কাগজ তো কাটলামই, একেবারে সব্বাই মিলে সকল কাজের কাজী হয়ে বসলাম। মাঝখানে কখন পিৎজা এলো, তার খরচ খরচা নিয়ে সিনিয়ার লোকজন একটু ভ্রূকুঞ্চন দেখিয়েও আবার পটাপট নিজেরাই হৈ হুল্লোড় করে তিন চারটে করে পিস্ খেয়ে ফেললেন আর আমিও সক্কলের সাথে মিলে গেলাম খেয়ালই হলোনা। রাত তিনটের সময় দেখা গেলো ব্যাপারটা একটু দাঁড়িয়েছে, একটা ছোট্ট বেদীর উপরে পুত্র কন্যা সহ দাঁড়িয়ে মা স্বয়ং আর তাঁর জ্যোতির্বলয় জুড়ে পটু ও অপটু হাতের কিছু কারুকীর্তি এবং অনেকগুলি উদ্বেল নবীন হৃদয়। নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে দিতাম কিন্তু একজন এসে তাড়া লাগলেন, তাঁকে পরের দিন সকালে এসে আবার ঘরের দরজা খুলতে হবে, পুজোর আয়োজন শুরু হবে সকাল সাতটা থেকে। তাঁর তীব্র সময়ানুবর্তিতাকে মনে মনে বহু ধিক্কার জানিয়ে সেদিনের মতো ঘরে ফিরলাম।   

পরের দিন সকালে আর উঠতে পারিনি, ভাবলাম এতে কি আর পাপ হবে, কালকে রাত্রে তো যাকে বলে জমিয়ে মায়ের পদসেবা করেই এসেছি। সন্ধে বেলায় একবারে ম্লেচ্ছ ড্রেসে হাজির হয়েছি, কিন্তু ঢুকেই বুঝলাম বড়ো ভুল হয়ে গেছে। গত কালকের যে ব্যস্ত ছেলেটি থ্রি কোয়ার্টার পরে হাতুড়ি নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছিল ঘরময়, আজ তার পরণে বাহারী শেরওয়ানি ও যত্নে বিন্যস্ত চুল, আর বাঙালী মেয়েরা চিরকালই শাড়িতে অপরূপা, আজ তাঁদের চেনাই মুশকিল। মাড় ভাঙ্গা শাড়ির খসখসানি ও অনভ্যস্ত পাঞ্জাবীর ফাঁক দিয়ে কিছু অপাঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় দেখে মনটা একটু খারাপ হলো, ইস্কুলে থাকতে এই একটি মাত্র অভ্যাসই হয়েছিল, তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে বেশ গুছিয়ে ধুতি পরতে পারতাম, সে বিদ্যে একেবারে মাঠে মারা গেলো। তারপরে কালচারাল অনুষ্ঠান শুরু হলো, সে বেশ জমাটি  ব্যাপার, তাতে নাচ গান কবিতা আবৃত্তি সবই হলো। শেষ পাতে এলো একটি অনবদ্য নাটক, অনেকদিন পরে এমন প্রাণ খুলে হাসলাম। শেষে খাওয়া দাওয়া গল্প স্বল্প এমনকি রাত্রে মায়ের প্রসাদও পাওয়া গেলো কিছু। এক দিনেরই উৎসব, কিন্তু তাতে আজীবনের প্রাণ ঢালা। এই হলো প্রবাসের পুজোর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। 

তার পর তো স্টেট কলেজে কত দিন কাটলো, কত অসম্ভব গল্পের জন্ম হলো, অযুত সম্ভাবনার মৃত্যুও দেখলাম, কিন্ত এই বচ্ছরকার দিনে সক্কলে মিলে যে আনন্দের উৎসব, তার কখনো ব্যত্যয় হয়নি। টাকা পয়সার টানাটানি হয়েছে, কেউ নিজের ভান্ডার উপুড় করে দিয়েছেন। বড়ো লেখকের লেখা নাটক করলে সব্বাই পার্ট পাবেনা, আমরা নিজেরাই লিখেছি নাটক। উচ্চাঙ্গের কিছু হয়নি, কিন্তু তার এক্সপেক্টেশনও ছিলোনা, পরিণতি তো লক্ষ্য নয়, জার্নিটাই আসল। নিজেরাই দল  বেঁধে বাজার করেছি, নিজেরাই রান্না। নিজেরাই নিজেদের পিঠ চাপড়েছি, গালি দিয়েছি, মান অভিমান করেছি, ভালোও বেসেছি। সব চেয়ে বড়ো কথা অজস্র বাধা বিপত্তিতেও কিছুই থামেনি, স্টেট কলেজ ছেড়েছি চার বছর, কিন্তু যতবার পুজোর আগের রাতে ফিরে গেছি সেই প্রথম দিনটির মতোই দেখেছি ঘর আলো করে দাঁড়িয়ে আছেন মা, আর তাঁকে ঘিরে অর্বাচীন উচ্ছল কিছু জীবন, যাদের ভালোবাসায় স্বর্গের দেবীকেও মাটিতে নেমে আসতে হয়। আমি যাঁদের প্রথম দিন দেখেছিলাম, তাঁরা নেই, আমিও নেই, কিন্তু পুজোটা আছে, ভালোবাসাটা আছে, গান গল্প স্বপ্ন গুলো আছে। আর কেউ যে নেই তাই বা কে বলতে পারে? নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে  নতুন বাহুর ডোরে, আসব যাব চিরদিনের সেই-আমি। 

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন আমরা অনেক সময় উৎসব করে ফতুর হয়ে যাই। নিঃস্বার্থ দান ছাড়া কোন উৎসবই বা সফল হয়? তিনি অসামান্য মানুষ, অনেক দানে তাঁর অধিকার। আমার দেওয়ার আছে স্বল্প, তাই প্রার্থনাও অতি সাধারণ। এ হতাশাজীর্ণ পৃথিবীর বুকে মা নেমে আসুন, শস্য শ্যামলা হোক মাটি। পাহাড় ঘেরা সেই ছোট্ট শহরটিতে সকলে সুখে শান্তিতে স্বাস্থ্যে থাক, আগমনীর আবাহনে প্রাণের কলরোলে ভরে উঠুক সেখানকার আকাশ বাতাস। মধুমৎ পার্থিবং রজঃ মধু দ্যৌরস্তু নঃ পিতা। সকলকে আগাম শারদ শুভেচ্ছা।

No comments: