কিছুদিন ধরে একটা প্রতিজ্ঞা নিয়ে বসে আছি যে সিনেমা দেখলে বাংলা সিনেমাই দেখবো, নয়তো ডকুমেন্টারি। এর ফলে বেশ কয়েকটা বাংলা সিনেমা দেখা হলো, এবং মা কি হইয়াছেন ধরণের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কদিন বসে রইলাম। কোলকাতায় হলে গিয়ে কেদারনাথ এর দশটি শো অগ্রাহ্য করে দেখেছিলাম জেনারেশন আমি, তার পরে বহুক্ষণ ভেবেও বুঝতে পারিনি এ কার জেনারেশন, আমার তো নয়ই, অথচ আমার হওয়ার ও কথা ছিল, আমিও তথাকথিত মিলেনিয়াল। খুব দুঃখে কাটালাম কয়দিন। তাহলে কি সত্যিই বুড়ো হয়ে গেলাম? তবে যে পড়েছিলাম আসলে কেউ বড়ো হয়না বড়োর মতন দেখায়? মামণি কে বললাম নেটফ্লিক্স দিতে।
নেটফ্লিক্সে প্রথম দেখলাম মেঘনাদবধ রহস্য। ভালো হয়েছে বলে আশা করছি, মানে পুরোটা দেখতে পারলে ঠিকঠাক বুঝতে পারতাম, কিন্তু সব কটা ক্যারেক্টার শুরুর থেকে এমন ঘ্যানর ঘ্যানর করে মাথা ধরিয়ে দিলে যে মিনিট চল্লিশের মধ্যে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ভরসা আছে প্রতিদিন তিরিশ মিনিট করে দেখে শিগগিরই ব্যাপারটা শেষ করে ফেলতে পারবো, যদিও এতো ঘটনার ঘনঘটা যে প্রতিদিন দশ মিনিট রাখতে হচ্ছে রিভিশন এর জন্যে। আকবর এর দাক্ষিণাত্য নীতি এর থেকে মনে রাখা সহজ ছিল, এবং ফ্র্যাঙ্কলি আরো ইন্টারেস্টিং ও।
তারপরে দেখলাম শব্দ। অনেকেই বলেছিলেন সিনেমাটা শুধু ঋত্ত্বিক চক্রবর্তীর জন্যেই দেখা যায়। যেটা বুঝিনি সেটা হচ্ছে এটা একটা ইফ এন্ড এলস কন্ডিশন। সিনেমাটা ঋত্ত্বিক এর জন্যে দেখা যায়, এবং বাকি সব কারণেই শুধু পরিহার্য নয়, পরিহার করাটাই কর্তব্য। সিরাজের মখমলি চিকেন রোল হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে শুরু করে সিনেমাটা যে সেকেন্ড হাফে অনিবার্য ডিম্ পরোটায় পরিণত হলো, তার জন্যে ঠিক কাকে দোষ দেব শিওর নই। খুব উপরের দিকেই থাকবে চূর্ণী গাঙ্গুলীর ঠোঁটচাপা উচ্চারণে অযুত জ্ঞানের হ্যাজ এবং সৃজিত মুখার্জির প্রায় গোটা সময় ধরে মরা গোরুর মতো নিশ্চল চোখে চেয়ে থাকা। ছোটবেলায় ইস্কুলে চুল অবিন্যস্ত থাকলে মুকুন্দ দা বলতেন কি ভেবেছিস চুল না আঁচড়ালেই আইনস্টাইন হবি? আমার ধারণা সৃজিত বাবু কোনো অভিনয়ই না করে রনবীর শোরের মতন আন্ডার এক্টিং করতে চেয়েছিলেন। ওনার দোষ নেই, ছোটবেলায় উনি তো মুকুন্দদা কে দেখেন নি। গোটা সিনেমা ধরে ভিক্টর ব্যানার্জী বলে গেলেন আই এম দ্য বেস্ট, কেন যে তার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। সলিউশন তো সেই ঘ্যানঘেনে চূর্ণীই দিলেন। সত্যি বলতে কি এই শেষ ব্যাপারটায় আমি এতোটাই ট্যান খেয়েছি যে বিশ্ব সিনেমার প্রতি আমার অজ্ঞতার উপরে না বোঝাটা ছেড়ে দিলাম। হতেও পারে উনি কিয়ারোস্তামির ভূত, যিনি পরবর্তী সিনেমায় অঞ্জন দত্তের কাঁধে চাপবেন।
(কৌশিক গাঙ্গুলীর দুটি সিনেমা আমার অসম্ভব প্রিয়, সিনেমাওয়ালা এবং ছোটদের ছবি। বিসর্জন, বিজয়া দেখিনি, কিন্তু শুধু অভিনেতা কৌশিক গাঙ্গুলীকে দেখার জন্যেই আমি এই সিনেমাগুলি দেখতে ইচ্ছুক)
এরপর দেখলাম ট্রেলার। শাহজাহান রিজেন্সির। দুটো কথাই বলার আছে। প্রথমতঃ গানটি আমার অসম্ভব প্রিয়। কিছুটা পার্সোনাল কারণেও, এবং সমস্ত মহান শিল্পই ডিপলি পার্সোনাল। খুব সংক্ষেপে বললে, প্রেমটা অনেকদূর গড়িয়ে গেলো এই গানটার জন্যেই। তখন অবশ্য সৃজিত মার্কেটে ছিলেন না। থাকলে কি হতো জানিনা। ভালো কিছু না আমি মোটামুটি নিশ্চিত। আর একটা ব্যাপার: এটা আগেও মনে হয়েছে যে সৃজিত এর সিনেমায় খুব স্পষ্ট, বোল্ড এন্ড আন্ডারলাইন প্যারালাল থাকে, যেমন ধরুন উমাতে উমার মা মেনকা বাবা হিমাদ্রী, এক যে ছিল রাজাতে "মহারাজ একি সাজে" গানের ব্যবহার। ভদ্রলোক সেই ধারা অক্ষুন্ন রেখেছেন দেখলাম। পতিতার মৃত্যু হলো পতনের ফলে। আহা ইস্কুলের সুনীতিদার বাণী মনে পড়ে যায়, অধঃপতনে শব্দ হয়না।
এই পরিস্থিতিতে আজকে দেখলাম একটা সিনেমা এসেছে কমলা রকেট। বাংলাদেশী সিনেমা, সিনেমার ডিরেক্টর বাংলাদেশের আরেক বিখ্যাত পরিচালক মোহাম্মদ সারোয়ার ফারুকীর আগের একটি সিনেমার নায়ক। ফারুকীর সিনেমা আমি প্রথম দেখতে শুরু করি ওনার স্টেডি নায়িকার জন্যে, যাঁর নাম নুসরাত ইমরোজ তিশা, অসম্ভব মিষ্টি একটি মেয়ে। তিনি এখন ফারুকীর বৌ ও বটে। আফশোষ এর কথা। এনিওয়ে, আই ডাইগ্রেস। এ বঙ্গের রিসেন্ট বাংলা সিনেমা দেখে (আমি সহজ পাঠের গপ্পো দেখিনি, এবং বিলু রাক্ষস ও নয়, দুটো সম্পর্কেই উচ্ছস্বিত প্রশংসা যাকে বলে রেভ রিভিউ পেয়েছি ফেসবুকে) আমি ক্রমাগতঃই একটা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগতে থাকি। প্রথমতঃ ক্যামেরা ঘরের বাইরে খুব একটা বেরোয় না, এবং ঘরের মধ্যেও যাদের উপরে ফোকাস করে তাদেরকে আমি একেবারেই চিনতে পারিনা। ঋতুপর্ণ ঊনিশে এপ্রিল করে সেই যে সাউথ সিটি তে ক্যামেরা ঢুকিয়ে দিলেন (তখন মনে হয় এসব ছিলোনা, হাইরাইজ বলতে মেঘমল্লার, যাগ্গে), তারপরে তো আর সে বেরোলোই না, এবং কোলকাতার উচ্চমধ্যবিত্তের সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো টলিউডের স্টেপল। অঞ্জন দত্ত মাঝখানে একটু হাঁউ মাঁউ করেছিলেন, বাংলা সিনেমায় সবাই ওয়াইন খায় কেউ বাজার যায়না কেন বলে। ঠিক তারপরেই বানালেন গণেশ টকিজ যেখানে বাড়ির ছাদে পৃথুলা নায়িকা কটাক্ষে কোমর দোলায় আমার ঝাল লেগেছে বলে। সুতরাং।
এইখানে চারটে বাংলাদেশী সিনেমা আমাকে অবাক করেছে। মনপুরা, টেলিভিশন, অজ্ঞাতনামা এবং কমলা রকেট। এই সিনেমাগুলি মধ্যবিত্তের চাউমিন খাবে না হাফ পেগ মদ ইত্যাদি ন্যাকা ক্রাইসিসের বাইরে বেরোয়। ক্যামেরা আদিগন্ত চরাচরে খেলা করে। নীল রঙে উঠে আসে হাওরের বিস্তার। এবং কি সৌভাগ্য গানগুলি স্ট্যান্ডার্ড ক্যালকেশিয়ান ইমেজারি এবং তৎসংলগ্ন ঘ্যানঘেনে সুর নিয়ে আঁকড়ে থাকেনা। আজকে আমি দেখেছি এদের মধ্যে শেষ সিনেমাটি। নেটফ্লিক্সে এভেলেবল। এই দীর্ঘ হ্যাজ তার ই ফলশ্রুতিতে। সিনেমাটি সম্পর্কে আমি এখনই কিছু লিখবোনা। কারণ সিরিয়াস কিছু লেখা এখন সম্ভব নয়। আর তা ছাড়া সিরিয়াস ফিল্ম রিভিউ করার যোগ্যতাও আমার নেই।
শুধু একটাই কথা বলার। আফজার নাফিসি বলে একজন ইরানিয়ান স্কলার একটি বই লিখেছিলেন, রিডিং লোলিটা ইন তেহরান। বইটার শেষে নাফিসির একটা ইন্টারভিউ রয়েছে, যেখানে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, কেন মানুষ বই পড়ে? নাফিসি বলছেন দুটো কারণে: টু নো এন্ড টু ফিল এম্প্যাথি। যেকোনো শিল্প কীর্তি বিশেষতঃ ন্যারেটিভ মূলক, যেমন সিনেমা, (সদ্য মৃণাল সেন মারা গেছেন তাই ফর্ম এর ব্যাপারে যারা গাঁতিয়েছে আমিও তাদেরই দলে, সুতরাং সিনেমা মানেই ন্যারেশন নয় এই এঙ্গেলে খেলবেন না) কেন ভালো লাগে তার জন্যে এর থেকে ফোকাসড উত্তর আমি পাইনি।
বাংলাদেশের সিনেমা দেখে যে এম্প্যাথি আমি ফিল করতে পারছি, দুঃখজনক হলেও এ বাংলার সিনেমা আমাকে সেই অবগাহন বোধ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তবু আমি ছাড়ছিনা। দেখে যাবো। একদিন নিশ্চয়ই দেখা হবে চন্দনের বনে।
No comments:
Post a Comment