Sunday, November 21, 2021

সংহিতা দি, রিমেমব্রেন্স, ১

 সংহিতাদি চলে গেলো। এই লাইনটা লিখে নিজেই আরেকবার চেয়ে দেখি। ঠিক দেখছি তো? কালকে দুপুরে তখন দুটো পঞ্চাশ, বাইরে ফেটে পড়ছে রোদ্দুর, পায়রা পিছলে যাবে এমন আকাশ। ফোনের ওপ্রান্তে পার্থদার কান্না শুনছি অঝোরে, নার্স বললো, আমরা দশ সেকন্ড দেবো, না রেস্পন্ড করলে, উই আর সরি। খুব ধীরে ধীরে সেই দশটি মুহূর্ত শেষ হলো, আমি ফোন রাখলাম। বাইরে তখন আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক, বসন্তের রং পেরিয়ে সবুজে ঢেকে যাচ্ছে সংসার। স্টেট কলেজে থাকলে সংহিতাদি ফোন করে বলতো, চল এতো ভালো ওয়েদার, একটু ঘুরে আসি আর আমরা কাজ টাজ ফেলে বেরিয়ে পড়তাম হঠাৎ। সেই নিরুদ্দেশে সংহিতাদি একাই চলে গেলো। পড়ে রইলো এ মায়াময় রাজপাট আর সাজানো ঘর গেরস্থালি। আমরা রয়ে গেলাম স্মৃতি কুড়োনোর মহা দায়িত্ত্ব নিয়ে।

"বিষণ্ণতা ছিল আমি মাথায় চড়তে দিইনি তাকে

অবসাদ দুশ্চিন্তারা রক্তমাখা আমাকে খুঁজেছে প্রতিদিন

অযথা ঘুমোতে আর অযথাই জেগে থাকতে কাঁহাতক ভালো লাগে আর?

আমার মাথাটা ছিল সবুজ ম্যাজিক

চলেছি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মনখারাপ মুছে দিতে দিতে।"

সংহিতাদির মৃত্যু নিয়ে আর কোনো কথাই বলবো না, যারা শেষ সপ্তাহটা দেখেনি, তাদের সে যন্ত্রণায় নিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয়না। আর যে মানুষটি সারাজীবন জীবনকেই সেলিব্রেট করেছে পাগলের মতন, তার শোকসভায় কেনই বা গম্ভীর বেদমন্ত্র উচ্চারণ হবে মৃদু সুরে? বরং সংহিতাদির কথা বললে আমরা বলবো পেনউডের সেই ম্যাজিকাল বাড়িটার কথা, যার দেওয়াল কিংবা দরজা জানলা কোনোটাই ছিলোনা, যখন খুশি ঢুকে পড়ে ইচ্ছে মতন আবদার করা যেতো। আজকে রাতের খাবারটা ভালো হয়নি, চল সংহিতাদির বাড়ি যাই। আজকে ল্যাবে দিন কেটেছে খুব বিরক্তিতে, চল সংহিতাদির বাড়ি যাই। রাত তিনটের সময় মদ খেয়ে বেরিয়েছি, খাবার দাবারের সন্ধান কোথায়? পেনউডে চল, ফ্রীজে কিছু আছে নিশ্চই। পার্থদা যখন এরিজোনায় চাকরি পেলো, প্রজেক্টর ভাড়া করে এনে দশ জন ছেলে মেয়ে মিলে আমরাই ওদের বাড়ি খুঁজলাম, কারণ আমরাইতো সেখানে থাকবো। সংহিতাদির বাড়ি তো আমাদেরই বাড়ি, সে বাড়ির উপরে যেন পার্থদারও দাবী অনেক কম। পার্থদা সে বাড়ির ভাড়া দেয়, একটু গম্ভীর মুখে পলিটিকাল আলোচনায় হয়তো যোগ দেয়, কিন্তু আমাদের সব হাসি ঠাট্টা আদর অভিমান সবার কেন্দ্রস্থলে তো বছর চল্লিশের সেই কিশোরী যে রাত তিনটের সময় মাতাল লোকজনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে চাঁদ দেখতে, কিংবা দরজা বন্ধ থাকলে জানলা বেয়ে উঠে যাবে তরতরিয়ে। সেই সব ঐন্দ্রজালিক বাড়িগুলো ছিল সংহিতাদির। আজ থেকে কি সেগুলো পার্থদার হয়ে যাবে? এ গুরুভার পার্থদা বইবে কেমন করে?

জীবনকে যারা গভীর ভাবে ভালোবাসে সংহিতাদির মতন, তাদের জন্যে সময় বড়ো কম থাকে মনে হয়। কিন্তু সেই সময়টুকুকেও সংহিতাদি নিংড়ে নিয়েছিল। যেমন ভালোবেসেছে মানুষকে, তেমন কি অসম্ভব যে ভালোবাসা পেয়েছে প্রতিটি মানুষের কাছ থেকে! এরিজোনা থেকে এক নার্স এই কোভিডের সময়ে আসছিলেন একবার দেখবেন বলে। গানে, আড্ডায়, বেড়ানোয় স্টেট কলেজের দিন কেটেছে বর্ণময়, কিন্ত অবাক হয়ে দেখলাম ২০১৬ তে যখন ওরা স্টেট কলেজ ছাড়লো, তার পরেও যারা এলো, একই রকম ভালোবাসার টানে পড়ে গেলো। ঈশ্বরেরও ঈর্ষা হয়েছে হয়তো, তাই কি এতো তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া? যখন ক্যান্সার ধরা পড়লো, প্রথমবার দেখতে গেলাম, খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম, কেমন দেখবো। দেখলাম সেই আগের মতনই মিষ্টি হাসি, সেই শাণিত রসবোধ। শেষের দিকে অসম্ভব যন্ত্রনাতেও কখনো বলেনি কষ্ট হচ্ছে, সারাজীবন রবীন্দ্রনাথের উপরে গভীর বিশ্বাসে প্রোথিত ছিল, আঘাত সে যে পরশ তব, সেই তো পুরস্কার। যদি একটি শিক্ষা সংহিতাদির জীবন থেকে পেয়ে থাকি, তা হলো এই নিঃশেষ পসিটিভিটি, জীবনকে উপভোগ করার এই দুর্দম আকাঙ্ক্ষা, কারণ এই অতল ভালোবাসার তল পাওয়া তো সম্ভব নয়; শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে? 

আমরা যারা স্টেট কলেজে ছিলাম, সংহিতাদির সঙ্গে ছিলাম, তাদের একটা উত্তরাধিকার রয়ে গেছে। দরজা বিহীন, দেওয়াল বিহীন সেই বাড়িটার উত্তরাধিকার। অনুপম বলতো আমি ম্যানহাটানে চব্বিশ তলার উপরে একটা বাড়ি কিনবো, সংহিতাদি বলতো কিনিস, তাহলে আমি সেখানে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে রাতের নিউ ইয়র্ক দেখতে দেখতে মুড়ি চানাচুর খাবো। সেইটা আর হয়ে উঠলোনা। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের বাড়ি তো একেকটা একান্নবর্তী পরিবার হয়ে উঠতেই পারে, যেখানে মানুষ জন ইচ্ছে মতো আসবে যাবে, খাবে, গল্প, গান করবে, প্রেম অপ্রেম, ভালোবাসার অনেক অনেক কাহিনী তৈরী হবে। কালকে শ্রিয়ার সঙ্গে গাড়ি চালিয়ে ফিরছি, হঠাৎ খুব ভাজা কিছু একটা খেতে ইচ্ছে করছিল। সিগনালে দাঁড়িয়ে আমরা আলোচনা করছি কি কেনা যায়, হঠাৎ মনে হলো, সংহিতাদি থাকলে তো এসব কিছু ভাবতেই হতোনা, সোজা বাড়ি ঢুকে গা এলিয়ে বসে আবদার করতাম আর সে সব মিটেও যেত অক্লেশে। এই রকম একটা বাড়ি আমি বানাতে চাই। সেই খানে হয়তো কোনো রাতে একদল ছেলে মেয়ে বসে উদাত্ত স্বরে গাইবে তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি, ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে রাজি আছি॥ তখন চাঁদের নরম আলো ঘিরে ধরেছে চারদিক, বাইরে হাওয়া দিচ্ছে খুব, যে সব হাওয়ায় মন কেমন করে। বাড়ির এক কোণায় একটা ছোট্ট আরাম কেদারা, তার পাশের নাইট স্ট্যান্ড থেকে আলো পড়ছে চুঁইয়ে চুঁইয়ে, আর সংহিতাদি হাসছে, সেই ভুবনভোলানো হাসি। নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ। ভালো থেকো, সংহিতাদি।

No comments: